Uttarkashi Tunnel Rescue Operation

১৭ দিনের উৎকণ্ঠার শেষ ৪৯ মিনিটে, সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধার বাংলার তিন-সহ ৪১ জন শ্রমিক, অবশেষে

গত ১২ নভেম্বর ভোরে উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে ধস নামে। ভিতরে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। এত দিন ধরে তাঁদের বার করার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করা হচ্ছিল।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
উত্তরকাশী শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:১২
uttarkashi tunnel collapse

উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে আটক ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করা হল। ছবি: পিটিআই।

অবশেষে অবসান হল ১৭ দিনের প্রতীক্ষার। উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে আটক ৪১ জন শ্রমিককে মঙ্গলবার রাতে একে একে উদ্ধার করলেন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ)-র জওয়ানেরা। তাঁদের উদ্ধার করতে খোঁড়া ‘ইঁদুরের গর্ত’ (যার পোশাকি নাম ‘র‌্যাট-হোল মাইনিং’) দিয়েই উদ্ধার করা হয় সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকদের।

Advertisement

ঘটনাস্থলে উপস্থিত উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ভিকে সিংহ। ৭টা ৫২ মিনিট নাগাদ সুড়ঙ্গ থেকে প্রথমে বেরিয়ে আসেন ঝাড়খণ্ডের বিজয় হোরো। তার পরে একে একে বাকিরা। রাত ৮টা ৩৮ মিনিটে শেষ হল ‘অপারেশন জিন্দেগি’। উদ্ধারের পরে আগে থেকে তৈরি রাখা গ্রিন করিডর দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরকাশীর চিনিয়ালিসৌর হাসপাতালে।

গত ১২ নভেম্বর ভোরে উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে ধস নামে। ভিতরে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। এত দিন ধরে তাঁদের বার করার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছিল না কিছুতেই। খোঁড়ার সময়ে গত শুক্রবার বাধা আসে। ধ্বংসস্তূপের ভিতরের লোহার কাঠামোয় ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায় আমেরিকায় তৈরি খননযন্ত্র। উদ্ধারকাজ থমকে যায়। উদ্ধার করার আগে পর্যন্ত সুড়ঙ্গের শ্রমিকদের সঙ্গে প্রশাসনের তরফে অনবরত যোগাযোগ রাখা হয়েছিল। পাইপের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে কথা চলছিল। পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল খাবার, জল এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

সুড়ঙ্গে থাকাকালীন উত্তরকাশীর শ্রমিকদের প্রথম ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসে গত মঙ্গলবার। পাইপের মাধ্যমে ক্যামেরা পাঠান উদ্ধারকারীরা। সেখানেই দেখা যায় সুড়ঙ্গের ভিতর কী ভাবে, কী অবস্থায় তাঁরা রয়েছেন। খননযন্ত্র ভেঙে যাওয়ায় দু’ভাবে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ নতুন করে শুরু হয়েছিল। খননযন্ত্রের সব টুকরোগুলি সুড়ঙ্গ থেকে বার করে আনার পর খনি শ্রমিকেরা সেখানে ঢুকে যন্ত্র ছাড়াই খোঁড়া শুরু করেন। ১০-১২ মিটার পথ সে ভাবেই খুঁড়ে ফেলার পরিকল্পনা ছিল। এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘ইঁদুর-গর্ত’ প্রক্রিয়া। ইঁদুরের কায়দায় গর্ত খুঁড়ে সুড়ঙ্গ থেকে শ্রমিকদের বার করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ ছাড়া, সুড়ঙ্গের উপর দিক থেকে উল্লম্ব ভাবে খোঁড়ার কাজও শুরু হয়েছিল। ৮৬ মিটারের মধ্যে মঙ্গলবার সকালের মধ্যেই খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল ৪২ মিটার।

উদ্ধারে ‘ইঁদুরের গর্ত’

বিভিন্ন খনি থেকে কাঁচামাল উত্তোলনের জন্য ‘ইঁদুরের গর্ত’ বা ‘র‌্যাট-হোল মাইনিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বিশেষত কয়লা খনিতে এই প্রক্রিয়া খুবই পরিচিত। এর মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ শ্রমিকেরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে খনিতে নামেন। তাঁরা অল্প জায়গা নিয়ে সরু গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে এগিয়ে চলেন। ঠিক যেমন করে গর্ত খোঁড়ে ইঁদুর। প্রয়োজনীয় কয়লা তুলে আবার ওই একই পদ্ধতিতে বেরিয়ে আসেন তাঁরা। আমেরিকান যন্ত্র বিকল হওয়ার পরে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে শ্রমিকদের বার করতে সেই মনুষ্য-নির্ভর এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল।

‘ইঁদুরের গর্ত খনন’-এর জন্য প্রথম দফায় ১২ জন বিশেষজ্ঞ খনিশ্রমিককে উদ্ধারস্থলে আনা হয়। তাঁরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এগোন। সুড়ঙ্গের ভিতরে পৌঁছে এক জন দেওয়াল খুঁড়তে থাকেন। অন্য জন সেই ধ্বংসস্তূপ সংগ্রহ করেন এবং তৃতীয় জন তা চাকা লাগানো গাড়িতে তুলে দেন। সেই গাড়ি ধ্বংসস্তূপ বহন করে সুড়ঙ্গের বাইরে নিয়ে যায়। শেয পর্যন্ত সেই পদ্ধতিতেই এল সাফল্য। ‘ইঁদুরের গর্ত’ খোঁড়ার পাশাপাশি সিল্কিয়ারায় উপর থেকে চলছে উল্লম্ব খনন। পাহাড়ের উপর থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে মাটি খুঁড়ে আটকে থাকা শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করা হয়।

সবচেয়ে বেশি ঝাড়খণ্ডের

প্রশাসনের দেওয়া তালিকা বলছে, বিজয় হোরোকে নিয়ে উদ্ধার পাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁদের বড় অংশই তফসিলি জনগোষ্ঠীর। বিশ্বজিৎ কুমার, সুবোধ কুমার, অনিল বেদিয়া, রাজেন্দ্র বেদিয়া, সুখরাম, টঙ্কু সর্দার, গুণধর, রঞ্জিত, রবীন্দ্র, সমীর, মহাদেব ভুক্তু মুর্মু, জমরা ওরাওঁ, গণপতি রয়েছেন এই তালিকায়। রয়েছেন বিহারের সাবা আহমেদ, সোনু শাহ, বীরেন্দ্র কিস্কু ও সুশীল কুমার। পূর্ব ভারতের আর এক রাজ্য ওড়িশার তপন মণ্ডল, ভগবান বাত্রা, বিশ্বেশ্বর নায়েক, রাজু নায়েক, ধীরেনও ১৭ দিন সুড়ঙ্গে বন্ধ থাকার পরে মুক্তি পেয়েছেন মঙ্গলের রাতে।

উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ কুমার, অঙ্কিত, রাম মিলন, সত্যদেব, সন্তোষ, জয়প্রকাশ, মনজিৎ ও রাম সুন্দর, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য অসমের সঞ্জয় ও রামপ্রসাদকেও উদ্ধার করেছে এনডিআরএফ বাহিনী। ৪১ জন শ্রমিকের মধ্যে উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা দু’জন— গব্বর সিংহ নেগি এবং পুষ্কর। তাঁদের পড়শি রাজ্য হিমাচল প্রদেশের বিশাল রয়েছেন উদ্ধার পাওয়া শ্রমিকদের তালিকায়। বাংলায় তিন শ্রমিক, কোচবিহারের মানিক তালুকদার এবং হুগলি জেলার সেবিক পাখিরা ও জয়দেব প্রামাণিকও রয়েছেন সেই তালিকায়। মানিকের স্ত্রী সোমা এবং পুত্র মণি উদ্ধারের খবর শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন মঙ্গলবার রাতে।

প্রধানমন্ত্রীর বার্তা

আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারের বিষয়ে গত ১৭ দিন অনবরত খোঁজ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি মুখ্যমন্ত্রী ধামীকে একাধিক বার ফোন করেছেন। মঙ্গলবার রাতে সফল উদ্ধারের পরে মোদী তাঁর এক্স পোস্টে লিখেছেন, ‘‘উত্তরকাশীতে আমাদের শ্রমিক ভাইদের উদ্ধার অভিযানের সাফল্য সবাইকে আবেগাপ্লুত করছে। এটা খুবই আনন্দের বিষয় যে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমাদের এই বন্ধুরা এখন তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। এই প্রতিকূল সময়ে এই সমস্ত পরিবার যে ধৈর্য ও সাহস দেখিয়েছে তার প্রশংসা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’’

পাশাপাশি উদ্ধারকাজে যুক্ত সকলকে অভিবাদন জানিয়েছেন মোদী। তিনি লিখেছেন, ‘‘এই উদ্ধার অভিযানে জড়িত সকলকে আমি সেলাম জানাই। তাঁদের সাহসিকতা ও দৃঢ়তা আমাদের শ্রমিক ভাইদের নতুন জীবন দিয়েছে।’’ এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের সহনশীলতার তারিফ করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। পাশাপাশি তিনি উদ্ধারকারীদেরও প্রশংসা করেছেন।

আরও পড়ুন
Advertisement