India and Bharat

মন্ত্রিসভায় ইন্ডিয়া-ভারত ‘সতর্কতা’ জারি করলেন প্রধানমন্ত্রী! তবে প্রকাশ্যে এখনও চুপচাপই কেন্দ্র

মঙ্গলবার রাতেই প্রধানমন্ত্রী মোদীর আসন্ন ইন্দোনেশিয়া সফরের সূচি এক্স (সাবেক টুইটার)- এর হ্যান্ডলে প্রকাশ করেন বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্র। সেখানে মোদীর পদ লেখা হয়েছে, ‘প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত’।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:৪১
narendra modi

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

কেন্দ্রের তরফে কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি। কিন্তু জি২০ শীর্ষবৈঠকে অংশ নেওয়া বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের কাছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্র আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইন্দোনেশিয়া সফরসূচিতে তাঁদের নয়া পরিচয়লিপি মঙ্গলবার প্রকাশ্যে আসার পরেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। ‘ইন্ডিয়া’ ছেঁটে ফেলে দেশের নাম শুধুই ‘ভারত’ করা হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে বিরোধীরা। এ সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল পাশের জন্যই আগামী ১৮-২২ ডিসেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে বলেও জল্পনা দানা বেঁধেছে।

Advertisement

এই আবহে ‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ বিতর্কে বুধবার বিরোধীদের মোকাবিলার দিশানির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাজনীতির জগতের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমেও জোরকদমে চলছে নামবদলের জল্পনা। এমনকি, উঠে আসছে এ সংক্রান্ত নানা পুরনো প্রসঙ্গও। মঙ্গলবার সমাজমাধ্যমে ভাইরাল রয়েছে আরজেডির প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান তথা বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদের একটি পুরনো সাক্ষাৎকারে ‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত২ বিতর্ক।

বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে মোদী ‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করার বিষয়ে সতর্কতা বজায় রাখার জন্য দলের মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর স্পষ্ট বার্তা— বিষয়টি নিয়ে সব নেতার কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। যাঁরা এ সংক্রান্ত বিষয়ে বিবৃতি দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁদেরও সতর্ক ভাবে মুখ খোলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিজেপি সূত্রের খবর, জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে মোদীর নির্দেশ, ‘‘ইতিহাস ঘাঁটতে যাবেন না। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান অনুসরণ করে বাস্তব অবস্থা তুলে ধরুন। সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলুন।’’

মঙ্গলবার সকালে জি২০ শীর্ষবৈঠকে অংশ নেওয়া বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের কাছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্র প্রকাশ্যে আসার পরেই জল্পনা শুরু হয়, লোকসভা ভোটের আগে দেশের নাম শুধুই ‘ভারত’ করতে চলেছে মোদী সরকার। রাষ্ট্রপতির ওই আমন্ত্রণপত্রে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি কাউকে কোনও চিঠি লিখলে তাতে চিরাচরিত ভাবে লেখা থাকে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ কথাটি। এ সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল পাশের জন্যই আগামী ১৮-২২ ডিসেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে বলেও জল্পনা দানা বাঁধে। যদিও সরকারি ভাবে এ বিষয়ে এখনও কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি।

ঘটনাচক্রে, মঙ্গলবার রাতেই প্রধানমন্ত্রী মোদীর আসন্ন ইন্দোনেশিয়া সফরের সূচি এক্স (সাবেক টুইটার) এর হ্যান্ডলে প্রকাশ করেন বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্র। সেখানে মোদীর পদ লেখা হয়েছে, ‘প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত’। যদিও সরকারি প্রথা অনুযায়ী তাঁর পদটিকে ‘প্রাইম মিনিস্টার অফ ইন্ডিয়া’ লেখা হয়। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর মোদী ইন্দোনেশিয়ায় যাবেন ২০তম ‘আসিয়ান-ইন্ডিয়া শীর্ষ সম্মেলনে’ যোগ দিতে। সরকারি নথিতে অবশ্য ওই সম্মেলনের নামের ক্ষেত্রে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক বিভ্রাট এড়াতেই এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও সরকারি ভাবে এখনও এ বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা, বিরোধীদের জোট নয়, দেশের নাম বদলের জন্য মোদী সরকারের ‘সম্ভাব্য উদ্যোগ’ আসলে ‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ তত্ত্ব নিয়ে আরএসএসের পুরনো অবস্থানের অনুসারী। সঙ্ঘ পরিবার বরাবরই ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার প্রতীক বলে চিহ্নিত করেছে। ভারতীয় সংবিধান যা-ই বলুক না কেন, আরএসএস নেতাদের যুক্তি, ব্রিটিশদের দেওয়া ওই নাম সনাতন সংস্কৃতি এবং ‘অখণ্ড ভারত’ চেতনার পরিপন্থী। এমনকি, মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০১৩ সালে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত অসমের শিলচরে বলেছিলেন, ‘‘ধর্ষণের ঘটনা ইন্ডিয়ায় ঘটে, ভারতে নয়।’’

বিরোধীদের একাংশ মনে করছেন, লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির এই ‘ভারত-ভক্তি’র প্রচার আরও বাড়বে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, তিন তালাক প্রথা রদ, আযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণের পরে ‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ এবং ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ প্রণয়নকেই পদ্ম শিবির প্রচারের মূল অভিমুখ করতে পারে বলে তাঁদের মত। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, মিজোরামের আসন্ন বিধানসভা ভোটেই তার ইঙ্গিত মিলতে পারে। বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেন, ‘‘এখন দেখা যাচ্ছে, ‘ভারত’ নাম নিয়েও বিরোধীদের আপত্তি!’’

লালুর সেই ‘ইন্ডিয়া-ভারত’ ভিডিয়ো

‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ ভারত বিতর্কের আবহে এ বার আরজেডি প্রধান তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদের একটি পুরনো মন্তব্যের ভিডিয়ো নিয়ে চর্চা শুরু হল সমাজমাধ্যমে। কয়েক বছরের পুরনো ওই ভিডিয়োয় লালুর মন্তব্য, ‘‘দিল্লি তো ইন্ডিয়া, এটা (বিহার) ভারত।’’ পটনার সরকারি বাংলোয় এনডিটিভি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লালুকে বলতে শোনা যাচ্ছে— ‘‘আমরা ভারতের লোক। নিমের দাঁতন করি।’’

নিমের ডালে দাঁতন করলে দাঁত এবং শরীর ভাল থাকে জানিয়ে লালু জানান পটনায় থাকলে তিনি দাঁতন ব্যবহার করেন। কিন্তু দিল্লিতে থাকলে বাধ্য হয়ে টুথব্রাশ ব্যবহার করতে হয়। তিনি বলেন, ‘‘এখানে (পটনায়) থাকলে আমি দাঁতন ব্যবহার করি। দিল্লি তো ‘ইন্ডিয়া’ সেখানে দাঁতনের ডাল পাওয়া যায় না। এটা ভারত, এখানে পাওয়া যায়।’’ নিম ছাড়াও আম এবং চিরতার দাঁতন ব্যবহার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল বলেও জানান তিনি।

মোদীকে চিঠি সনিয়ার

‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ বিতর্কের আবহে সংসদের আসন্ন বিশেষ অধিবেশনে ন’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার আর্জি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চিঠি দিলেন কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেত্রী সনিয়া গান্ধী। বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার জন্য সময় বরাদ্দের আবেদন জানানোর পাশাপাশি সরকারকে নিশানা করে চিঠিতে বলা হয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনা না করে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। এর ফলে সংসদে কোন বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হবে, সে বিষয়ে বিরোধী দলগুলি অন্ধকারে বলেও চিঠিতে অভিযোগ তোলা হয়েছে। সনিয়ার প্রস্তাবিত ন’টি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকদের সমস্যা, জাতগণনা, হরিয়ানার মতো কয়েকটি রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হওয়া। মণিপুরে গোষ্ঠীহিংসা, এমনকি আদানি-বিতর্কও।

সংসদের বিশেষ অধিবেশনে কেন্দ্র কী করতে চলেছে, সেটা আঁচ করে কৌশল ঠিক করতে মঙ্গলবার রাতে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের বাসভবনে ইন্ডিয়া-র দলগুলি বৈঠকে বসেছিল। পরে কংগ্রেসের লোকসভার উপনেতা গৌরব গগৈ বলেন, ‘‘বিশেষ অধিবেশন কেন ডাকা হল তা নিয়ে সরকারের তরফে কোনও কথা বলা হয়নি। আমাদের দাবি, বিশেষ অধিবেশনের কর্মসূচি কী, তা জানানো হোক।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমরা দেশের মূল সমস্যাগুলির সমাধানে ইতিবাচক অধিবেশন চাই।’’ গগৈয়ের দাবি, ইন্ডিয়া-র দলগুলির ঐক্য দেখে কাঁপছে বিজেপি। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। তিনি বলেন, ‘‘সংসদের বিশেষ অধিবেশনে সরকারের কর্মসূচি কী, তা গোপন রাখা হচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটা হওয়ার কথা নয়।’’

‘ভারতে আছেন’ অভিনেত্রী কঙ্গনা

‘ইন্ডিয়া বনাম ভারত’ বিতর্কে বুধবার ঢুকে পড়ল বলিউডও। ‘বিজেপি ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত জানিয়েছেন, ‘ইন্ডিয়া’ নয়, দেশের নাম ‘ভারত’ হওয়া উচিত। পাশাপাশি অভিনেত্রীর দাবি, বছর দুয়েক আগেই নাকি দেশের নাম বদলের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি!

২০২১ সালে কঙ্গনা একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়া’ নাম থেকে দূরে থাকা উচিত, আমরা ভারতীয় এবং আমাদের দেশ ভারত। ‘ইন্ডিয়া’ দাসত্বের প্রতীক বলেই মত তাঁর। বছর দুয়েক আগে তিনি যে কথা বলেছিলেন, তা নিয়ে এখন সরগরম দেশের রাজনীতি। বছর দুয়েক আগে করা সেই বক্তব্য বুধবার নিজের এক্স প্রোফাইলে (সাবেক টুইটার) আবার পোস্ট করেন অভিনেত্রী। তবে শুধু নিজের করা পোস্ট নয়। এক অনুরাগীর পোস্টও নিজের এক্স প্রোফাইলে পোস্ট করেছেন। সেখানেই অভিনেত্রীর প্রশংসা করে ওই অনুরাগী লেখেন, “সব সময়ই সময়ের চেয়ে এগিয়ে ভাবেন কঙ্গনা।” তার উত্তর দিয়ে অভিনেত্রী লেখেন, ‘‘আরে লোকে ভাবে আমি কালাজাদু জানি। এটা সাধারণ বুদ্ধি। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে পাওয়া নাম থেকে মুক্তি… জয় ভারত।’’

সেই সঙ্গে ভারত নামের গুরুত্ব বোঝাতে কঙ্গনা বলেন, “ভারত নামের গুরুত্ব আছে, কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’ নামের অর্থ কী? ব্রিটিশরা সিন্ধু উচ্চারণ করতে পারত না। তাই সেটা অপভ্রংশ করে ‘ইন্দুস’ করেছিল। তার পর কখনও ‘হিন্দুস’, কখনও ‘ইন্দুস’ এইসব বলতে বলতে ইন্ডিয়া নাম দিয়ে দিল। ইন্ডিয়া নামের মানে বোঝাতে গিয়ে কঙ্গনা বলেন, ‘‘পুরনো ইংরেজিতে ইন্ডিয়ান বলতে বোঝায় দাস। ব্রিটিশরা আমাদের ইন্ডিয়ান নামকরণ করেছিলেন। কারণ সেটাই (দাস) ছিল ব্রিটিশদের চোখে আমাদের পরিচয়। তাই আমরা ইন্ডিয়ান নই, ভারতীয়।’’

আরও পড়ুন
Advertisement