‘বস্তার-দ্য নকশাল স্টোরি’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
‘বস্তার-দ্য নকশাল স্টোরি’ মুক্তি পেয়েছে বেশ কিছু দিন হল। বস্তার নামটার সঙ্গে খবরের কাগজের সূত্রে আমাদের পরিচয় অনেকদিনের৷ ছত্তিশগড়ের এই জনপদ যে মাওবাদী-অধ্যুষিত তাও সকলের জানা। কয়েক বছর আগে বাঙালি চিকিৎসক বিনায়ক সেনকে গ্রেফতারের ঘটনায় বস্তারের কথা অনেক বেশি ছড়ায় সাধারণের মধ্যে। সম্প্রতি একটি ছবি তৈরি হয়েছে সেই জনপদকে ঘিরে। কিন্তু বস্তারের সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিক, যে কোনও মানুষকে সেখানে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা কি যথাযথ? প্রশ্ন থেকেই যায়।
দুনিয়ায় সবচেয়ে বিক্রিত পণ্যগুলির মধ্যে আজ অনিবার্য ভাবে এসে পড়ে নকশাল বা মাও আন্দোলনের নাম। যেমন সত্যি, গেঞ্জিতে চে গেভারাকে ছাপানোটা এখন ‘ফ্যাশন স্টেটমেন’। তাই তাকে ঘিরে পরের পর ছবি হবে, এ খুব আশ্চর্যর কথা নয়। তবে সাম্প্রতিক ভারতে এইসব গেরিলা অভ্যুত্থানকে যে পথে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু করে তোলা হচ্ছে, তা চিন্তা জাগায় বৈকি। ‘বস্তার: দ্য নকশাল স্টোরি’ ছবিতেও প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে যে ভাবে মাওবাদীরা নির্বিচারে হিংস্র খুন করছে দেখানো হল, তাতে মনে হল, তাঁদের কোনও রাজনৈতিক বা দার্শনিক মতাদর্শ নেই, স্রেফ খুন করা ছাড়া। এমনকি সাধারণ গ্রামবাসীদের সঙ্গেও যেমন ব্যবহার দেখানো হয়েছে ছবিতে, তাও অনেকক্ষেত্রে সত্যের অপলাপই বলা যায় বোধহয়। পাশাপাশি সাংবাদিক থেকে বুদ্ধিজীবীদের যে ভূমিকা বিশেষত এই ছবিতে দেখানো হয়েছে এই গোটা সমস্যাকে ঘিরে, তাও একপেশে বলে মনে হয় অনেক ক্ষেত্রে।
আমাদের সাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে ব্যাপক সমাদর পেয়েছে সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’-‘কালপুরুষ’-‘উত্তরাধিকার’। সে উপন্যাস পাঠে আমরা কিন্তু সমাজের আগুনের পাশাপাশি দেখি ব্যক্তি সম্পর্কের জটিল রসায়নও। শিল্প, তা সে বিষয়ে রাজনৈতিক হোক বা না হোক, তার গঠনে একটা রাজনীতি আছে। এবং তা গড়ে তুলতে যত্নের দরকার। আলোচ্য ছবিতে সে যত্নের বড় অভাব রয়েছে। অনস্বীকার্য যে আজকের মাওবাদ আর সত্তরের নকশাল আন্দোলনের আদর্শগত পার্থক্য প্রচুর, তবু সত্যটা হল ছবির ‘ট্রিটমেন্ট’-এ মনে হয় যেন একটানা একটা ‘মনোলগ’ যন্ত্রের মত বলে গেল ছবিটা। শুরু-মধ্য-অন্তের কাঠামো নেই। অনর্গল একটা মাওবাদের প্রতি-রাজনৈতিক বক্তব্য, যাকে বলা যায় একটা ‘কম্বো মিল’ই যেন এ ছবি, যার শিল্পের নিপুণতার বদলে মূল উদ্দেশ্য- কীভাবে প্রমাণ করা যায়, অরণ্যের দিনরাত্রির এইসব মানুষেরা আসলে খারাপ!
অরণ্যের একটি প্রান্তিক পরিবার, যারা ভারতের পতাকা তোলায়, সে পরিবারের স্বামীকে নির্বিচারে খুনের ঘটনা দেখানো হয়েছে এ ছবিতে। এমন ঘটনা ঘটে না তা নয়। খবরের কাগজ খুললেই তা জানা যায়৷ কিন্তু যে পদ্ধতিতে খুনটা দেখানো হল, তার সঙ্গে দক্ষিণী ছবির হিংস্রতার বেশি মিল পেলাম। এত হিংস্রতা কেন? স্বভাবতই প্রশ্ন তৈরি হল। একে কি অন্যভাবে বলা যেত না? একটা মুহূর্তকে ক্যামেরায় কীভাবে ধরা হবে, তা নির্ভর করে পরিচালকের মনের উপর। সেটা বাস্তবসম্মত হবে, না একপেশে— সেটা নির্ভর করে পরিচালকের বিশ্বাস কোনদিকে ঝুঁকে, তাঁর সাংস্কৃতিক বোধ কেমন, তার উপর। দুর্ভাগ্য যে মনে হল, এ ছবিতে খারাপকে আরও খারাপ দেখাতেই তৎপর এ ছবির কাণ্ডারীরা? তার বাইরে দিগন্তের সভ্যতার দিকে তাকানোর বাসনাই যেন তাঁদের নেই।
তবে, ছবিতে সুব্রত দত্ত, রাইমা সেনদের অভিনয় ভালো লাগে। বিশেষ করে, এ ধরনের গেরিলা অভ্যুত্থানকে ঘিরে কর্পোরেট মিডিয়া জগতের যে রাজনীতি তথা ভণ্ডামি-তা রাইমার চরিত্রটির মধ্যে যথাযথ ভাবে ধরা পড়েছে। ভালো লাগে অদা শর্মা, ইন্দিরা তিওয়ারিদেরও। ইন্দিরার চরিত্রটির যে ভাবে ক্রমাগত পরিবর্তন আমরা দেখি, যেখানে সাধারণ গ্রাম্য বধূ থেকে সে হয়ে ওঠে মাওবাদী সৈন্য তা বড় সংবেদনশীল মনে হয়। যেমন বাস্তব মনে হয় অদা শর্মার পরিবার ছেড়ে নিজের পেশার প্রতি সৎ থেকে অরণ্যে পড়ে থাকার ঘটনাটিও।
আজকের ভারতে স্বাধীনচিন্তক অরুন্ধতী রায় বা স্ট্যান স্বামীকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে রোজ সরগরম হয়ে ওঠে খবরের কাগজ। সদ্যই যে নির্বাচন গেল, তাতে এ বিষয়গুলো বারবার সামনে এসেছে। সেখানে এমন একটা বিষয় নিয়ে ছবি করার সময়ে আরও বেশি যত্ন, আরও বেশি গবেষণা, আরও বেশি সংবেদনের প্রয়োজন ছিল, যা এ ছবিতে পাওয়া গেল না৷ আশা করা যাক, পরিচালক সুদীপ্ত সেন, বিপুল অম্রুতলাল শাহ সেটা খেয়াল রাখবেন। খেয়াল রাখবেন, ভারতবর্ষের এ হেন বিষয় খুব সুখের মারামারি নয়। বরং অতীব ভীষণ এক সমস্যার প্রকাশ। তা নিয়ে শিল্প বানাতে গেলে মানুষকে আরেকটু ভালোবাসতে হয়, স্রেফ আগে থেকে কিছু ধারণা নিয়ে নেমে পড়লেই চলে না, এটুকুই বলার।