ছবির একটি দৃশ্যে অভিনেতারা। ছবি: সংগৃহীত।
কোনও পেশাদার অভিনেতা নন, বাংলাদেশের রেললাইনের পাশের বসতির বাসিন্দারাই এ ছবির প্রধান পাত্রপাত্রী। সেই বসতি যাপনের ছবিই সে দেশে এনেছে নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ছবি দেখল আনন্দবাজার অনলাইন
রেলের চাকার শব্দে সেখানে সন্ধ্যা নামে। রাতের অন্ধকারে শুরু হয় জীবিকার লড়াই। একটু ঘুমের জন্য এঁদো গলির মধ্যে পড়ে থাকা এক টুকরো কাঠের তক্তা বা স্টেশনের ভাঙা বেঞ্চির দখল নিতে রক্ত ঝরে। পড়ে থাকা শিশি, বোতলের শব্দ আর ফেলে দেওয়া আবর্জনা জড়ো করে তৈরি করা আগুনের উত্তাপে জীবন এগিয়ে যায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। টঙ্গি জংশনের এই বস্তিতে জীবনকে টেনে নিয়ে যেতে হয়, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপেই মিশে থাকে মৃত্যুর গন্ধ। দক্ষ ড্রাইভারের মতো বিপদকে পাশ কাটিয়ে এগোতে এগোতে কখন যে ওরা লাশ হয়ে যায় কে জানে! এই জানা- অজানার অনিশ্চিত জীবন সংগ্রামে বিরতি নেই। এখানে থেমে যাওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া... ফুরিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের টঙ্গি জংশন স্টেশনের পাশের বসতি এমনই এক আদিম সভ্যতার চলমান জলছবি, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই যেন এক একটা কাহিনি। প্রতিদিনের সেই কাহিনিগুলিই ক্যামেরাবন্দি করেছেন পরিচালক যুবরাজ শামিম, ‘আদিম’ ছবিতে।
ওই চলমান জীবন সংগ্রামকে সেলুলয়েডে নিয়ে আসার জন্য পরিচালক যুবরাজকেও জীবন বাজি রাখতে হয়েছে। শুধুমাত্র এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করবেন বলে প্রায় ছয় মাস এই বস্তিতেই কাটিয়েছেন শামীম। কাছ থেকে দেখেছেন বাসিন্দাদের জীবন, তাঁদের লড়াই, তাঁদের সংগ্রাম। তাঁদের সঙ্গে থেকে, তাঁদের জীবনের ওঠানামার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান তিনি। প্রথমেই সবাই তাঁকে মেনে নেয়নি। কখনও ভেবেছে ড্রাগ মাফিয়া, কখনও ভেবেছে খুনি, ডাকাত। প্রায় ছ’ মাস ওখানে থাকার পর শুরু হয় শুটিং, তাই ছবিতে তথাকথিত কোনও গল্প নেই। অন্ধকার গলিপথে, বেঁচে থাকার জন্য প্রতি দিন স্বাভাবিক ভাবেই যে গল্প তৈরি হতে থাকে, সেই গল্পই ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি হয়ে উঠেছে। এই ছবিতে কোনও অভিনেতাও নেই, কারণ এখানে কেউই অভিনয় করেননি। বসতিবাসীরাই এই ছবির চরিত্র। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই বসতিবাসীর রোজনামচাই ‘আদিম’ ছবির জমজমাট কাহিনি, যেখানে মানুষের পায়ের শব্দে তৈরি হয় টান টান চিত্রনাট্য।
বসতির মধ্যেই মাদক বিক্রি করে কালা। ভাঙা টিন আর প্লাস্টিকের আস্তরণের একচিলতে ঘরে বউ সোহাগীকে নিয়ে প্রতিটি দিন-রাত কাটিয়ে দেয় সে। কালার বন্ধু ল্যাংড়া। তার জীবন তার ধরানো প্রতিটা সিগারেটের ধোঁয়ার মতোই ভাসমান। সে উড়ে বেড়াতে ভালোবাসে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মনের মানুষ খুঁজে বেড়ানোটাই তার নেশা। ক্রাচটাকে শক্ত করে ধরে, শারীরিক প্রতিবন্ধী ল্যাংড়া সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই বসতির চারপাশে জীবনকেই খুঁজে বেড়ায়। গভীর রাতে তার ঠিকানা স্টেশনের একটা ভাঙা বেঞ্চি। এটাই যেন তার পালঙ্ক। কুকুর আর অনাহুত মানুষকে সরিয়ে ল্যাংড়া তলিয়ে যায় তেল চটচটে কম্বলের নীচে। রাত শেষে শুরু হয় আরও একটা দিন, আরও একটা জীবন। ল্যাংড়া মাঝেমাঝেই তার বন্ধু কালার বাড়িতে যায়। কালা তাকে বেশ পছন্দ করে। কালার বউ সোহাগী তাকে যত্ন করে খাওয়ায়। এই আসা-যাওয়া, পছন্দ- অপছন্দের মধ্যেই তৈরি হয় সম্পর্ক, সোহাগীকে ল্যাংড়ার চোখে ধরে। সে সোহাগীকে না দেখে, সোহাগীর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারে না, তাই ছুতোয়-নাতায় কালার বাড়িতে যাওয়া শুরু করে ল্যাংড়া। ক্রমে ল্যাংড়া ও সোহাগীর মধ্যে একটা সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি হয়। একদিন, কালার চোখে ধুলো দিয়ে ওরা দু’জন পালিয়ে যায়। এর পর গল্প এগোয় তার নিজস্ব ছন্দে। এই কাহিনি কোনও গল্পকারের কলম থেকে জন্ম নেয়নি, ফলে জীবন প্রবাহের নিজস্ব ছন্দে গল্প এগিয়ে গিয়েছে। পরিচালক সেই এগিয়ে যাওয়াটাকেই ক্যামেরাবন্দি করেছেন।
ছবি দেখতে দেখতে কখনওই মনে হয় না যে, গোলাপি বেগম, আনোয়ার, দুলাল বা বাদশারা কোনও প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা নন, তাঁরা এই বসতিরই জীবন্ত এক একটি চরিত্র। বিশেষ করে কালা, ল্যাংড়া ও সোহাগীকে মনে থাকবে দর্শকের। সিনেমাটোগ্রাফি এই ছবির সম্পদ। বসতি জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটিকে যত্ন করে ক্যামেরায় তুলে আনার জন্য যে মনন, যে দৃষ্টির প্রয়োজন, সেটা সিনেমাটোগ্রাফার আমির হামজার রয়েছে। ছবির প্রতিটি মুহূর্তে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এই ছবির সঙ্গীত ও আবহ মনে দাগ কাটে। ছবির বেশ কিছু দৃশ্য, যেমন, ল্যাংড়া ও সোহাগীর পালিয়ে যাওয়া, স্টেশনে ল্যাংড়ার হেঁটে যাওয়ার পাশাপাশি ট্রেনের বেশি গতিতে চলা, বসতির মধ্যে গানের দৃশ্যে কালার তাল দেওয়া, স্টেশনে ল্যাংড়াকে খুন করতে যাওয়া, ইত্যাদি দৃশ্যগুলি অবশ্যই আন্তর্জাতিক স্তরের কাজ। তবুও কিছু কথা বলার থাকে। গল্প শুরু হওয়ার পর পরিচালক ‘ডিটেলিং’-এর অমোঘ লোভ ছাড়তে পারেননি, তাই গল্পের গতি খানিক বাধা পেয়েছে। চরিত্র নির্মাণও ধাক্কা খেতে খেতে এগিয়েছে ‘ডিটেলিং’কে মূলধন করার জন্য। তাই বেশ কিছু অসাধারণ দৃশ্য দেখাতে দেখাতে এগোলেও, কোথাও যেন গল্পের সঙ্গে একাত্মতা কমেছে। ল্যাংড়ার বার বার সিগারেট ধরানো এবং বার বার একই রকম ট্রেন যাওয়ার দৃশ্য শেষের দিকে একঘেয়ে লেগেছে। ছবিটি দেখতে দেখতে বার বার মনে হয়েছে, ছবিটি ‘ডকু-ফিচার’ নয় তো?
এই ধরনের সামান্য কিছু বিষয় নির্দ্বিধায় সরিয়ে রাখা যায় কারণ এমন একটা ছবি বানানোর জন্য যে সাহস এবং ধৈর্যের প্রয়োজন, সেটা অনেক পরিচালকেরই থাকে না। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্পেশ্যাল জুরি পুরস্কার, আমেরিকার কুইন্স ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘বেস্ট ফ্র দ্য ফেস্ট’ খেতাব, নেপালের হিউম্যান রাইটস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বেস্ট ইন্টারন্যাশন্যাল ফিকশন’ পুরস্কার বোধহয় সেই সাহসেরই পুরস্কার। ছবিটি দেখা যাচ্ছে ‘চরকি’ ওটিটি প্যটফর্মে।