‘আবার রাজনীতি’ ওয়েব সিরিজ়ের চরিত্রেরা। ছবি: সংগৃহীত।
জীবনের কোনও মুহূর্তই রাজনীতির বাইরে নয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্কেও থাকে রাজনীতির টানাপড়েন। আর্থ-সামাজিক চালচিত্র জুড়ে রাজনীতির নানা রং। এর কোনও সরল সমীকরণ হয় না।
রাজনীতির মতো একটি বহুভোগ্য বিষয়কে বেছে নিয়েছেন পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী, যা এই মাৎস্যন্যায়ের মুহূর্তে খুব জরুরি। পরিচালকের প্রথম ওয়েব সিরিজ় ছিল ‘রাজনীতি’। সহজ সরল নামকরণ। ‘রাজনীতি’-র প্রথম পর্যায়ে কাহিনীর বাঁকে বাঁকে ছিল কী হয়-কী হয় উত্তেজনা। ন্যায় অন্যায়ের দুর্ধর্ষ ঘাতপ্রতিঘাত।
পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা রিজপুর টাউনশিপে আসন্ন লোকসভা উপনির্বাচন নিয়ে সেখানকার বনেদি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে যে টানাপড়েন শুরু হয়েছিল তা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে দেখতেই সাত পর্বের সিরিজ় শেষ হয়ে গিয়েছিল। গত মে মাসে মুক্তি পেল দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘আবার রাজনীতি’। স্বাভাবিক ভাবেই দু’টি পর্যায়ের উপস্থাপনা, পরিচালনা, অভিনয় ইত্যাদি বিষয়ে তুলনা চলে আসতে বাধ্য।
সিরিজ়ে সাদা কালো দাবার ছক, সাজানো ঘুঁটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, চরিত্রেরা সকলেই ঘুঁটি। কেউ বোড়ে, কেউ রাজা-মন্ত্রী। আড়াল থেকে কেউ যেন দাবার চাল দিয়ে চলেছে। সবাই দাবা যুদ্ধে নিয়তির পুতুল। পৃথক অস্তিস্ব বলে কিছু নেই।
প্রথম সিরিজ়ে দেখা যায় রিজপুরের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কর্তা রথীন বন্দ্যোপাধ্যায় (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়) নির্বাচনের মুখ করে তুলতে চাইছেন তাঁর মেয়ে রাশিকে (দিতিপ্রিয়া রায়)। পরিকল্পিত এক দুর্ঘটনায় রাশি স্মৃতিভ্রংশ হয়ে প্রায় কোমায় চলে গিয়েছিল। সেখান থেকেই গল্প মোড় নেয় রোমহর্ষক রাজনৈতিক থ্রিলারের দিকে। সিরিজ়ের শেষ পর্বে রথীনের মৃত্যু হয় তাঁর স্ত্রী মল্লিকার (কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) চক্রান্তে। ‘আবার রাজনীতি’ দেখতে বসলে পুরনো গল্প এইটুকু জানলেই চলবে।
দ্বিতীয় সিরিজ় ‘আবার রাজনীতি’-তে ফিরে আসেন বহু নিখোঁজ থাকেন রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই প্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়। এই চরিত্রেও অভিনয় করেছেন কৌশিক। দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় হলেও লোকমান্য সমাজ পার্টির অধিনেতা ধূর্ত এবং দুঁদে রাজনীতিক রথীন অনেক বেশি উজ্জ্বল। প্রতিমের অনুজ্জ্বলতার দায় অবশ্য চিত্রনাট্যের। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর বেশে প্রতিমের বহু বছর বাদে রিজপুরে ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে ঠিক যতটা আলোড়ন ওঠা উচিত ছিল ততটা উঠল না। অথচ প্রতিমকে ঘিরে জল্পনা কল্পনা রহস্যের অন্ত ছিল না।
সন্তের সাজে, আচারে আচরণে, দার্শনিক সংলাপে ভাল মানিয়েছে কৌশিককে। চিত্রনাট্য অনুযায়ী তাঁর অভিনয়ও যথাযথ। দর্শকের তাঁকে দেখে ভালো লাগবে। কিন্তু চরিত্র বয়নে যেন খাদ থেকে যায়।
আজকের সমাজে রাজনীতির চেহারাটা যেমন ঠিক সেই ভাবেই তৈরি হয়েছে কাহিনির বাঁক ঝোঁক, বুনট। একে একে জনগণের দাবি দাওয়াতে উঠে এসেছে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। উঠে এসেছে দুর্নীতির বিভিন্ন দিক। তাঁর মধ্যে ‘আবার রাজনীতি’-তে প্রকট হয়ে উঠেছে চিটফান্ড কেলেঙ্কারি। রয়েছে প্রমোটারি ব্যবসার ভুলভুলাইয়া জালিয়াতি। সমাজের নানামুখী জ্বলন্ত সমস্যা ‘আবার রাজনীতি’-র ভরকেন্দ্র।
রাজনীতিতে কী ভাবে পরিবারতন্ত্র যুগ যুগ ধরে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে, তা ‘আবার রাজনীতি’-তে উগ্র ভাবে ফুটে উঠেছে সৎ মা (কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) ও মেয়ে রাশি (দিতিপ্রিয়া)-র লড়াইয়ে। দিনে দিনে পরিণত হচ্ছে কনীনিকার অভিনয়। দিতিপ্রিয়াও ক্রমশ প্রস্ফুটিত। রাশির স্বামী শৌনকের চরিত্রে অর্জুন চক্রবর্তী। এমনই এক জটিল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি যে শিরদাঁড়া বেয়ে হিমেলস্রোত নেমে যায়। রাজনীতিতে কত মানুষের কত রং বদলায়। এই রং বদলের পাশা খেলায় কেউ কেউ নীতি, ধর্ম, আদর্শ আঁকড়ে রেখে লড়াই চালিয়ে যায় খাঁটি মানুষের মতো। রিজপুরের এমনই এক চরিত্রের নাম রিঙ্কু মল্লিক। দলের দূষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এই চরিত্রে সেরা অভিনয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন যিনি, তিনি শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য।
‘আবার রাজনীতি’-র উপভোগ্যতা আসলে নির্ভর করে রয়েছে অসাধারণ অভিনয়ের উপর। আর তারই ফলে সমসময়ের দর্পণ হয়ে উঠেছে এই ছবি। ‘রাজনীতি’ এবং ‘আবার রাজনীতি’ দুই সিরিজ়ই দেখা যাচ্ছে ‘হইচই’-তে।
রাজনীতির এই চড়াই-উতরাই রিজপুর নির্বাচনী ক্ষেত্রকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায়, তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী সিরিজ়ের জন্য।