‘শ্রী চারশোবিশ’ ছবির একটি দৃশ্যে রাজ কপূর। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
রাজ কপূর শতবর্ষে প্রবেশ করছেন এবং তিনি সম্ভবত বিখ্যাততম ভারতীয় নায়ক। এই সংবাদ ততটা জরুরি নয়। বরং আমার মনে হয় মজার বিষয়, দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষও পৃথিবীতেই বিখ্যাত থাকেন। কিন্তু রাজ কপূরের ‘আওয়ারা হুঁ’ গানটি মানুষের প্রথম মহাকাশযাত্রায় ইউরি গ্যগারিনের সঙ্গে মহাকাশযানে ছিল। অর্থাৎ তিনিই প্রথম, যিনি ইউরির সঙ্গে সঙ্গে অভিকর্ষের টান উপেক্ষা করেছিলেন।
দেশভাগের বিষাদ নিয়ে সাধারণত আলোচনা হয়। কিন্তু আমরা খেয়াল করি না, আজ পর্যন্ত মুম্বইয়ের যাঁরা সবচেয়ে জননন্দিত নায়ক, তাঁরা প্রত্যেকেই দেশভাগের ফসল। রাজ কপূর এবং দিলীপ কুমার এসেছিলেন পেশোয়ার থেকে। দেব আনন্দ আসেন পঞ্জাব থেকে। এক দিক থেকে ভারতীয় সিনেমার সেই সময়টা খুবই কৌতূহল জাগায়। কারণ সেই সময়ে যে ধরনের সাংস্কৃতিক জলবায়ু চারপাশে ছড়িয়ে ছিল, তাতে গল্পের আবরণ ছড়িয়ে দিলে মোলেড্রামার পটভূমিটি স্বচ্ছ হয়ে পড়ে। আর রাজ কপূর ছিলেন আমাদের মেলোড্রামার সবচেয়ে আদৃত মুখ।
কোন সময়ে তিনি ভারতীয় ছবিতে জায়গা করে নিলেন? যখন রানির কণ্ঠহার অস্তমায়ায় করুণ। ইংরেজ উপনিবেশের স্মৃতি ক্রমশ আবছা হয়ে উঠছে। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ভারতীয় সাধারণতন্ত্র। বিদায় নিচ্ছেন অশোককুমার এবং বলরাজ সাহনি, এমনকি তাঁর পিতা পৃথ্বীরাজ কপূরও। এই সময়ে নায়কের অবস্থানে এসে পড়লেন রাজ কপূর। ভারতীয় সিনেমায় এক ঋতুবদল ঘটল। রাজের মুখই যেন সেই লাবণ্য, যা গাম্ভীর্য থেকে মুগ্ধতার দিকে টেনে নেয় আমাদের। ফরাসি পণ্ডিত রলাঁ বার্ত হলিউডে এমন ‘মুখ’ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘‘অ্যাশিওরস দ্য প্যাসেজ ফ্রম অ টু চার্ম (যা শ্রদ্ধা থেকে আকর্ষণের জন্মকে সুনিশ্চিত করে)।’’
সমাজতত্ত্বের বিন্দু থেকে দেখলে, সেই সময় ক্রমশ দূর-দুরান্ত থেকে লোকজন এসে শহরে ভিড় করছে। অবসান হয়ে আসা পল্লিজীবন তখন শহরের আনাচ-কানাচে। মনে রাখতে হবে, রাজ যেমন মূলত গ্রাম থেকে শহরে চলে আসেন, তেমনই ‘শাপমোচন’ ছবির নায়ক উত্তমকুমারও কিন্তু ছবির গল্পে গ্রাম থেকে কলকাতায় পা রাখেন। এই স্থানান্তর উপলক্ষে দু’জনেই জনতার মন জয় করে নেন। ‘শাপমোচন’ও তখন প্রবল সফল। গ্রাম থেকে শহরে আসার এই সেন্টিমেন্টই তখন মানুষকে টানছে। এই চাহিদাকে মাথায় রেখে কলকাতার মতোই তৎকালীন বম্বে শহরের সিনেমাতেও এক অলীক গ্রাম তৈরি হচ্ছে। ফলে উত্তমকুমারের মতোই রাজ কপূরও কোথাও গিয়ে শহরের লোককথায় ‘অবিসংবাদিত সম্রাট’ হয়ে উঠলেন। গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্ব, নগরায়নের দোলাচল কিছু আধিক্য তৈরি করে ঠিকই, তবে মেলোড্রামায় এই অতিশয়োক্তিই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এই অতিকথনের আদর্শ দৃষ্টান্ত ছিলেন রাজ কপূর। তাঁর সাফল্যের উৎস হচ্ছে এই মেলোড্রামার মুহূর্তটিকে একেবারে হিরের আংটির মতো ব্যবহার করা।
রাজ কপূর তা হলে কী? বলা যায়, তিনিই সরকারি সিলমোহর, সদ্য-স্বাধীন দেশে জাতিগঠনের স্মারক। রাজ কপূরকে দেখলে বুঝতে পারি, এক দিকে যেমন বাস্তববাদ ভারতীয় ছায়াছবির জন্য একটি মানচিত্র তৈরিতে ব্যস্ত, তখন অতিনাটকীয়তার আদলে গ্রাম থেকে শহরে আসার অভিজ্ঞতা ও দেশের নানা বাঁধন নিয়ে সেলুলয়েডে তিনি পরীক্ষা করে চলেছেন। ‘আওয়ারা’, ‘বুট পলিশ’, ‘শ্রী চারশো বিশ’— উত্তর-স্বাধীনতার কালের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় জনজীবনের আধুনিকতার দোলাচলকে এঁকে দেয়।
এই যে কথা বলছি, তার মাঝখানে ‘রাজ কপূর’ নামটা উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে— ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি/ ইয়ে পাতলুন ইংলিশস্তানি/ সর পে লাল টোপি রুশি/ ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’। এই গানটি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে জাতীয় সঙ্গীতের বিকল্প হয়ে উঠেছিল। প্রায় যেন আমাদের বিদেশনীতি। একমাত্র উদারীকরণের পরেই আমরা এই গানটিকে ফেরালাম। এবং যখন ফেরালাম, তখন রাজ কপূর আর এই গানের অংশ নন, তিনি যেন এ কালের শাহরুখ খান (ছবির নাম ‘ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’) হয়ে উঠেছেন। অর্থাৎ, রাজ কপূরকে বাদ দিয়ে আধুনিক ভারতে জাতীয়তাবাদের ইতিহাস তৈরি হয় না।
একটা মজার তথ্য হয়তো অনেকেই জানেন না, রাজ কপূর থাকতেন এই কলকাতা শহরে, কালীঘাটে হাজরা রোডে। তাঁর বাবা পৃথ্বীরাজ কপূর এক সময় নিয়মিত প্যারাডাইস ক্যাফেতে আড্ডা মারতেন। রাজও সেই রাস্তা দিয়ে চলাচল করেছেন। মেট্রোয় নিয়মিত সিনেমা দেখতে যেতেন। কলকাতা শহর রাজের অত্যন্ত পরিচিত। তাঁর জীবনের প্রথম ছবি তো কলকাতা থেকেই। পরিচালক ছিলেন দেবকীকুমার বসু। প্রয়োজক নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো। ছবির নাম ‘ইনকিলাব’। যদিও রাজ কপূরের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ছবি মুক্তি পায় আমাদের স্বাধীনতার বছরে। সেই ছবির নাম ‘নীল কমল’। ছবিতে মধুবালার বিপরীতে নায়ক হিসেবে রাজের আত্মপ্রকাশ। যদিও ১৯৪৯ সালে ‘আন্দাজ়’ ছবিতে, যে অতিনাট্যের কথা এত বার বলছি, তা বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়। তবে সেখানেও রাজ কপূর এবং দিলীপকুমার একত্রে ছিলেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, রাজ কপূর প্রথম মেঘমুক্ত হলেন ‘আওয়ারা’র অবিশ্বাস্য সাফল্যে। এই ছবিতে নারী এবং শিশুর সঙ্গে আদালত এবং আইনের যে সংঘর্ষ, পরবর্তী ‘বুট পালিশ’ (টাইম ম্যাগাজ়িন যাকে ‘ক্ষুদ্রাকার মহাকাব্য’ নামে অভিহীত করে) বা ‘শ্রী চারশো বিশ’ ছবিতেও সে রকম দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এর থেকে বোঝা যায়, রাজ কপূর একটি দেশের গ্রাম থেকে শহরে হেঁটে আসার পথে যে ওঠাপড়া, যে রাজনৈতিক পালাবদল, যে রক্তপাত ও যন্ত্রণা— এগুলিকে এক রূপকথার আঙ্গিকে প্রকাশ করছেন। তিনি সমাজের সঙ্গে কথা বলছেন। তারই সঙ্গে একটু প্রেম, যৌনতা আর গান যে ভাবে জড়িয়ে দিচ্ছেন, তা অনেক সময়েই ‘ব্যালাড’-এর রূপ নিচ্ছে। যেন জাতির গল্পকথা। একটি জাতি বটগাছের নীচে বসে গল্প শুনত। সেই গল্পটাই এ বার সে সেলুলয়েডে দেখছে। আধুনিকতার মূল রহস্যটা রাজ কপূর ধরতে পেরেছিলেন।
এই রাজ কপূরেরও কিন্তু বদল হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যখন ‘মেরা নাম জোকার’, ‘ববি’ বা ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ নির্মাণ করছেন, তখন কিন্তু তিনি মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির প্রবর্তন করছেন প্রযোজক হিসেবে অবতীর্ণ। সেখানে লক্ষ্মী-সরস্বতীর মধ্যে প্রথম জনের দিকেই পাল্লা ভারী। এখানেই চলচ্চিত্র সমালোচনা একটু হোঁচট খায়। ১৯৫৬ সালে ‘জাগতে রহো’ ছবিতে রাজ এমন এক চরিত্রে অভিনয় করছেন, যে কি না গ্রামের তৃষ্ণার্ত কৃষক। সে শহরে এসে একটু জল পাচ্ছে না। উল্টে তাড়া খাচ্ছে। এই ছবি গণনাট্য আন্দোলনের ঘরানায় তৈরি। পরে যখন রাজ কপূর আরকে ফিল্মসের ব্যানারে নাচে-গানে ভরপুর ছবি করেছেন, তখনও গননাট্য তাঁর পিছু ছাড়েনি। ‘শ্রী চারশো বিশ’ ছবিতে তিনিই সেই কপর্দকশূন্য মানুষ, যাকে চার্লি চ্যাপলিনের ছবির আলোচনায় আমরা ‘ট্র্যাম্প’ বলি। ১৯৭০ সালে রাজ যখন ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিটি তৈরি করলেন, তখনও সেই গরিব ট্র্যাম্প-সুলভ চরিত্রটিই কেন্দ্রে। আবার ১৯৬৬ সালে বাসু ভট্টাচার্যের ‘তিসরি কসম’ এমনিতে একটি প্রেমের ছবি। এখানেও রাজের চরিত্র হিরামন প্রায় সব খোয়ানো একজন মানুষ। রাজ কপূর নিঃসন্দেহে ‘ভারতীয় চ্যাপলিন’ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুললে চলবে না, আইপিটিএ-র পৃথ্বীরাজ কপূর তাঁর বাবা। সময় অনেক কিছু পাল্টে দেয়। আমরা দেখি, ‘ববি’র চিত্রনাট্যকারদের মধ্যে খাজা আহমেদ আব্বাস, যিনি ১৯৪৬ সালে তৈরি ‘ধরতি কে লাল’-এর পরিচালক, সেই ছবির প্রেরণা ছিল বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’। রাজ কপূর ‘ববি’ ছবিতে চিত্রনাট্যের দাবি মেটাতে, আপাত ভাবে শ্রেণিবৈষম্যের কথা বলছেন বটে, সেই সঙ্গে কিশোরী ডিম্পল কপাডিয়ার সঙ্গও বেশ খোলামেলা ভাবে উপস্থাপন করছেন, দর্শকের চোখ যেন বিনোদনের আনন্দও পায়। এই ঘটনা ঘটছে জ়িনাত আমনকে নিয়ে তৈরি ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ এবং মন্দাকিনীকে নিয়ে ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ ছবিতে। রাজ কপূরকে যে ভারতীয় সিনেমার সর্বশ্রেষ্ঠ ‘শো ম্যান’ বলা হয়, তা খুব একটা ভুল নয়। তিনি নায়ক হিসেবে দারিদ্র বিক্রি করেছেন এবং প্রযোজক হিসেবে তাঁর পসরা ছিল নিসর্গ ও নারী। আসলে আমরা সিনেমাকে যখনই বিচার করেছি, তখনই তা কতটা ‘আর্ট’ হয়ে উঠল, তা নিয়ে ভেবেছি। ভাবিনি যে, সিনেমা জনসাধারণের স্বপ্নকেও প্রায় অনুবাদ করে দেয়। রাজ কপূরের সিনেমা সমাজের আশা-নিরাশা, দোলাচল, ব্যর্থতা ও সাফল্যকে এমন ভাবে বুনতে পারে, যে তা বারে বারে গ্রাম-শহরের মডেল হয়ে উঠতে পারে। যেমন ষাটের দশকে ‘সঙ্গম’ ছবিটি প্রেমের মধ্যে আরও নৈকট্যের বাসনা জুড়ে দেয়।
আসলে, জীবনের চেয়ে সিনেমাকে তখন মানুষ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। সেটা বুঝে সিনেমার মতো আটপৌরে একটা গয়নাকে অভিনয় এবং গল্প বলে যাওয়ার মুনশিয়ানায় ঝলমল করে তাতে জীবনের গন্ধও ছিটিয়ে দিয়েছেন রাজ কপূর। জন্মশতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে উপায় আছে!
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)