সুচিত্রা সেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সুচিত্রা সেনের প্রয়াণের পরে প্রায় ১০ বছর কেটে গেল। এর মধ্যে আমাদের ডিজিটাল যুগ শুরু হল। কোভিড পর্ব শেষ হল। তবু আজও এই ভদ্রমহিলার কথা ভাবলেই মনে হয়, তিনি নন্দনবাসিনী। তিনি হয়তো এই মুহূর্তে দেবলোকে অমরাবতীতে ‘শিল্পী’র নায়িকার মতোই উদাসীন বসে আছেন এবং আজও মৌবনে তেমন ভাবেই মৌ জমে। সুতরাং অবধারিত প্রশ্ন, এই কান্তিময়ী বাঙালিনি হিসাবে তিনি কে? তিনি কি শুধুই দর্পিতা কোনও অভিনেত্রী, না কি ইতিহাসের কোনও নির্বাচিত মুহূর্ত? যদি আমি ‘স্ট্রাকচার্ড পলিসেমি’ জাতীয় কোনও শাস্ত্রীয় শব্দবন্ধ না-ও ব্যবহার করি, তবুও দেখব, তিনি ব্যক্তির অতিরিক্ত এক সামাজিক সংলাপ। তিনি সুন্দরীতমা, কিন্তু তিনি সময়ের মুখপাত্র।
অভিনেত্রী হিসেবে তিনি কত বড়, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তিনি মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বা কানন দেবীর তুলনায় বড় বা ছোট কি না, সে নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু যেখানে তিনি প্রত্যেককেই তর্কাতীত করে দেন, তা হল তাঁর অপরূপ মুখশ্রী। যে দিকে বাঙালি মধ্যবিত্তের ইতিহাস তাকিয়ে থাকে।
সুচিত্রাদির কালপর্বে মুখের কারুকাজ আলাদা করে দেখার অবসর ছিল মানুষের। গ্রেটা গার্বোর ‘ক্রিস্টিনা’, সুচিত্রার ‘রিনা ব্রাউন’ ও মধুবালার ‘আনারকলি’-কে এ ভাবেই অলৌকিক রেখাচিত্র মনে হত আমাদের। গ্রেটা গার্বো জানতেন, তাঁকে কী করতে হবে, দর্শক তাঁর কাছে কী প্রত্যাশা করে। ফলে যে পরিচালকই নায়িকা হিসেবে বেছে নিন না কেন, তিনি নিজে আলোকচিত্রী হিসেবে বেছে নিতেন উইলিয়াম ড্যানিয়েলসকে। ফলে ছবির পর ছবিতে তাঁর মুখাবয়ব একটি ঐতিহ্য রচনা করে রেখেছিল।
কেন জানি না আমার মনে হয়, বাংলা ছায়াছবির জগতে অজয় কর ও সুচিত্রা সেনের সম্পর্কটি এ রকম হতে পারত। সুচিত্রার যে আহত ভ্রুবিলাস অথবা যন্ত্রণাবিধুর মুখচ্ছবি, যেন দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা সাদাকালোর অলৌকিকতায়, অজয় কর তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন ‘হারানো সুর’ ( ১৯৫৭), ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১), ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬৩) নামে তিনটি ছবিতে। এ ভাবে বিভূতি লাহার ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪), ‘পথে হলো দেরি’ (১৯৫৭) ছবি দু’টিকেও একই সূত্রে গাঁথা হিসাবে দেখা যেতে পারে। অজয় কর সুচিত্রার চুলের ফাঁকে ফাঁকে একটি ব্যাকলাইট ব্যবহার করেছেন, তাতে হলিউডি মেলোড্রামার বদলে হিন্দু পৌরাণিকতা প্রশ্রয় পায়। কলহান্তরিতার আধার যে মুখ ‘হারানো সুর’ রচনা করে অথবা যখন মত্ত মাধবীলতার মতো রিনা ব্রাউন ট্রেনের ধাতব শব্দে কাঁপতে থাকা আয়নায় কৃষ্ণেন্দুকে ভাঙতে দেখে ভ্রষ্ট স্মৃতি উদ্ধার করে, সেখানে যৌনতার উপস্থিতি গৌণ না হলেও অস্পষ্ট। তা মুখ সম্পর্কে এক প্লেটোনিক অপার্থিব সৌন্দর্যের ধারণা দেয়।
ফরাসি মনস্বী রলাঁ বার্ত গ্রেটা গার্বোর মুখে এই যৌন অনির্ণেয়তা খেয়াল করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকের বাঙালি পৌরুষও নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে যৌন উদ্বেগে অতিরিক্ত পরিসরে সুচিত্রাকে দেখে ভাবতে পারে “অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে”। এমন যোগ্যতা বাংলা ছবিতে কানন দেবীর পরবর্তী কালে একমাত্র সুচিত্রা সেনেরই। কানন দেবীর ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে কপালের টিপ যদি আসমুদ্রহিমাচলের যুবতীদের ললাটলিখন হয়ে থাকে, তবে সুচিত্রা সেনের বাঁকা চাঁদের মতো হাসি সংখ্যাতীত যুবকের নিদ্রাহরণ করেছিল। বস্তুত উত্তম কুমারের সঙ্গে যে তিনি স্বর্গের কিন্নরী হয়ে উঠেছেন তা তো নয়, এক জন দর্পিতা কিন্তু নিঃসঙ্গ অবসিতযৌবনা ব্যক্তিত্ব ভাবতে চাইলেও গুলজার ‘আঁধি’-তেও তাঁর কথাই ভাবেন।
আর বিমল রায়ের সূত্রে তাঁর ‘পার্বতী’ তো পঞ্চাশের দশকে জাতীয় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলই। গ্রেটা গার্বোর মতোই তাঁর একটি মোহিনী আড়াল আছে। এর জন্য পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি একটি ‘ধারণা’, নিছক উত্তম-সঙ্গিনী কোনও ‘ঘটনা’ নন। আমাদের নায়িকাদের মধ্যে এমন স-জীবনী (অ্যাক্টর উইথ আ বায়োগ্রাফি) অভিনেত্রী আর কই? সুচিত্রা সেন নিজেকে দ্রষ্টব্য করে তুলতে জানতেন। যে কারণে গসিপ তাঁকে তাড়া করে ফিরত, তিনি আড়ালে থাকলেও। এ বার বলার কথা, সুচিত্রা সেন অভিনেত্রী কত বড়, তা আমি জানি না। কিন্তু তিনি যে একমেবাদ্বিতীয়ম নক্ষত্র, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। দেশভাগ-উত্তর যে বাঙালি আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলেছিল তার হঠাৎ মনে হওয়া স্বাভাবিক, ‘হারানো সুর’ বা ‘শাপমোচন’ যা কার্যত ‘শকুন্তলার আংটি’, স্মৃতিভ্রষ্ট আমাদের মনে করিয়ে দেবে অন্তত একদা আমরা উনিশ শতকে আধুনিকতার সঙ্গে সফল দাম্পত্যে যুক্ত হতে পেরেছিলাম। সদ্যস্বাধীন গণতন্ত্রে আমাদের যে স্বাধিকার দরকার হয়েছিল, তিনি সুচিত্রা সেন। তাঁকে আমরা অহঙ্কারী এবং অভিমানিনী— এই দুই ভূমিকায় সচল দেখি। তাঁর আহত ভ্রুবিলাস, অপার স্বায়ত্তশাসন এবং কর্তৃত্বকে ছলনা করার একটি বিশেষ প্রকাশভঙ্গি নির্দেশ করে।
উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এক তন্বী নাগরিকার, যিনি আমাদের নতুন আকাঙ্ক্ষাগুলিকে নতুনতর রং দিতে পারেন। যে যুবক কোনও দিন শ্রাবণে বা বৈশাখে স্তব্ধ মুহূর্ত খুঁজে পায়নি, গ্রামীণ সমাজ যাকে নির্জনতা দেয়নি, সে সুচিত্রা সেনের মধ্যে খুঁজে পায় সীমা হারানোর সীমা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে সেই দৃশ্যকল্পের জন্ম দেয়, যা জায়মান নাগরিকতার ছাড়পত্র। সুচিত্রা সেনকে আমার প্রায়ই বাঙালির ব্রিজিত বার্দো মনে হয়। আমাদের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় শরীরী সন্ত্রাস তত জরুরি নয়। আর বার্দোর নগ্নতায় সেই বেপরোয়া উৎসব বাদ দিলে দু’জনেই চিরবালিকা। অবুঝ আর অভিভাবক ভাবে প্রেমিককে। আপাত ভাবে তাঁদের যতটা স্বাধীনতাপ্রিয় মনে হয়, ‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড উওম্যান’ ও ‘সপ্তপদী’-তে তাঁরা ততটাই পুরুষের ছায়ায় কাটাতে চান। তিনি ততটা নারী নন, যতটা নতুন নারীত্বের জন্য পুরুষের অনুমান ও আশ্রয়স্থল।
সুচিত্রা সেনের বিদ্রোহ সংস্থা ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে বিপন্ন করে না বলেই তিনি অবিরত প্রচারমাধ্যমের সহায়তা পান। হয়ে ওঠেন স্বাতন্ত্র্যের এক কল্পিত শিলমোহর। হয়তো ‘নীতা’ বা ‘চারুলতা’ হওয়া তাঁর সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁর নিষ্পাপ কৌমার্য ও দগ্ধ বাসনা তাঁকে ‘সপ্তপদী’ বা ‘উত্তর ফাল্গুনী’তে যে পরিসরে নিয়ে যায়, তা সময়ের নিষ্ঠুর চুম্বন সত্ত্বেও অক্ষয়। অজয় করের সফ্ট ফোকাস ক্লোজ় আপ বলে দেয়, আজও তিনি আমাদের মায়াকাননের ফুল। এই যে সমাজতাত্ত্বিকেরা দাবি করেন, অতিকথা সৃজনে নারী পুরুষের তুলনায় বেশি কার্যকরী, উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রা সেনকে মিলিয়ে দেখলেই তা অনেকটা বোঝা যায়। সেই কবে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ (১৯৫৪) ছবিতে দেবকীকুমার বসু তাঁকে “এলাইয়া বেণী, চুলের গাঁথুনী” দিয়ে শ্যামের বাঁশি শোনালেন, অজয় কর ও অসিত সেন তাঁকে কলহান্তরিকা শ্রীরাধিকা হিসেবে গড়ে তুললেন, আর আমরা আধুনিকতার ফ্রেমে সে ছবি বাঁধিয়ে তাঁর মুখকে সময়-নিরপেক্ষ করে ভাবলাম, “তার নাম অবসর তুমি যে আজ স্তব্ধ সমীরণ”। আজ আবার ১০ বছর বাদে তাই মনে হচ্ছে, তিনি এমন এক অবসর, যেখানে বায়ুও স্তব্ধ হয়। বায়ু মধুময় হয়ে ওঠে।