Pushpa 2 in Bengali

ডাবিং করেছিলেন শিল্পীরা, তার পরেও ‘পুষ্পা ২’ কেন বাংলা ভাষায় মুক্তি পেল না?

এক সপ্তাহ আগে মুক্তি পেয়েছে ‘পুষ্পা ২: দ্য রুল’। বাংলা ভাষায় ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:০২
Despite dubbing why Pushpa 2 did not release in Bengali version in West Bengal

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় মুক্তি পায়নি ‘পুষ্পা ২: দ্য রুল’। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

নির্মাতারা ঘোষণা করেছিলেন তেলুগুর পাশাপাশি আরও কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষায় মুক্তি পাবে অল্লু অর্জুন অভিনীত ছবি ‘পুষ্পা ২: দ্য রুল’। যার মধ্যে হিন্দি, তামিল, কন্নড়, মালয়ালম এবং বাংলা ছিল। তবে এ রাজ্যে সুকুমার পরিচালিত ছবিটি শুধুমাত্র তেলুগু এবং হিন্দিতে মুক্তি পেয়েছে। দেশের অন্য রাজ্যে স্থানীয় ভাষায় মুক্তি পেয়েছে ‘পুষ্পা ২’। কিন্তু ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ। অথচ বাংলায় ছবির ডাবিং করিয়েছিলেন নির্মাতারা। বাংলায় ছবির ট্রেলার প্রকাশ করা হয়। মুক্তি পায় বাংলার শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো ছবির বেশ কয়েকটি গানও। গান গেয়েছেন শ্রেয়া ঘোষাল, তিমির বিশ্বাস, উজ্জয়িনী মুখোপাধ্যায় এবং অর্পিতা চক্রবর্তীর মতো শিল্পীরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় কেন মুক্তি পেল না ছবিটি? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি কলকাতা শহরেই ‘পুষ্পা ২’-এর ডাবিংয়ের কাজ শুরু হয়। অন্য ভাষার ডাবিংয়ের জন্য যা সময় বরাদ্দ ছিল, তুলনায় বাংলার কাজ অনেকটাই কম সময়ে শেষ করতে হয়। প্রথমে হায়দরাবাদের একটি সংস্থার অধীনে ডাবিংয়ের কাজ শুরু হয়। কিন্তু পরে তা হাত বদল হয়ে আসে কবি শ্রীজাতর কাছে। বাংলায় ছবির গান লেখা থেকে শুরু করে বাংলা চিত্রনাট্য তাঁরই লেখা। সেই মতো, ছবিতে বাংলার জন্য কারা কণ্ঠ দেবেন, তার জন্য অডিশন পর্বও চলে। এই প্রসঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে শ্রীজাতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ফোন বা মেসেজের উত্তর তিনি দেননি।

বলিউডে অনেক সময়ে ইংরেজি ছবির হিন্দি ডাবিংয়ের ক্ষেত্রে পরিচিত অভিনেতাদের ব্যবহার করা হয়। সবটাই প্রচারের স্বার্থে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বড়দিনে মুক্তি পাচ্ছে অ্যানিমেটেড ইংরেজি ছবি ‘মুফাসা: দ্য লায়ন কিং’। ছবিটির হিন্দি সংস্করণে ‘মুফাসা’ চরিত্রের কণ্ঠদান করেছেন শাহরুখ খান এবং তেলুগুতে মহেশবাবু। তবে ‘পুষ্পা ২’-এর নির্মাতারা বাংলার ক্ষেত্রে কোনও পরিচিত তারকার কণ্ঠের পরিবর্তে, যাঁরা নিয়মিত ডাবিং করেন, সেই ধরনের পেশাদার কণ্ঠশিল্পীদেরই ব্যবহার করেছেন।

আগে ছিল টিভি। এখন ওটিটির দৌলতে হিন্দি এবং দক্ষিণী ছবি বাংলাতেও নিয়মিত দেখেন দর্শক। তবে ডাবিং শিল্পীদের পরিশ্রম অনেক সময়েই প্রচারের আড়ালেই রয়ে যায়। এক কণ্ঠশিল্পীর কথায়, ‘‘এ রকম একটা ছবি ডাবিং হওয়া সত্ত্বেও মুক্তি পেল না। যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা তো সমাজমাধ্যমে জানাতেও পারছেন না তাঁদের প্রাপ্তির কথা। কারণ ছবিটাই তো বাংলায় মুক্তি পায়নি!’’ ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ দিন ডাবিং শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন অবর্ণা রায়। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘কলকাতায় ডাবিংয়ের একটা সমান্তরাল ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। প্রচুর শিল্পী নিয়মিত কাজ করেন, সামান্য পারিশ্রমিকে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের কাজের কোথাও কোনও স্বীকৃতি নেই। মানুষ জানতেও পারেন না। ‘পুষ্পা ২’ বাংলায় মুক্তি পেলে হয়তো ডাবিং শিল্পীদের আরও সুবিধা হত।’’

‘পুষ্পা ২’-এর জন্য বাংলায় ডাবিং শিল্পীদের যে গতিতে কাজ করতে হয়েছে, তাতে কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, তো কেউ আবার কাজের চাপে নিজের বিয়ের প্রস্তুতিই ঠিক ভাবে নিতে পারেননি বলে খবর। প্রযোজনা সংস্থার তরফে দু’জন প্রতিনিধি কলকাতায় এসে পুরো কাজটির তদারকি করেন। লক্ষ্য ছিল, বাংলায় একটা ভাল কাজ দর্শককে উপহার দেওয়া। বাংলায় অল্লু অর্জুনের কণ্ঠের জন্য নির্বাচিত হন শুভায়ন রায়। ডাবিং শিল্পী হিসেবে প্রায় ১০ বছরের অভিজ্ঞতা তাঁর। আনন্দবাজার অনলাইনকে শুভায়ন বললেন, ‘‘প্রায় দিন-রাত এক করে আমরা ডাবিং শেষ করেছিলাম। এমনকি কোনও সংশোধন এলে, সেটাও আমাদের দ্রুত করে দিতে হত।’’ ৫ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ‘পুষ্পা ২’। শুভায়ন জানালেন, ৩ ডিসেম্বর পর্যন্তও তাঁরা ডাবিংয়ের কাজ করেছিলেন। কিন্তু তার পর হঠাৎ জানতে পারেন, ছবিটি বাংলায় মুক্তি পাচ্ছে না। শুভায়নের আক্ষেপ, ‘‘এ রকম বড় মাপের একটা ছবি বাংলা ভাষার মুক্তি পেলে অনেকগুলো দরজা খুলে যেতে পারত। অন্তত কলকাতায় একটা শো-ও যদি দেওয়া হত, তা হলে ডাবিং শিল্পীদেরও একটা পরিচিতি তৈরি হত।’’ ফলে ওটিটিতে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত বাংলায় ছবিটি দেখা যাবে না বলেই শোনা যাচ্ছে।

ছবির বাংলা সংস্করণে রশ্মিকা মন্দানার চরিত্রের ডাবিংয়ের জন্য নির্বাচিত হন দেবশ্রী মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে এতটা অবহেলা কেন, আমি জানি না। ডাবিং ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কেউই ভাবেন না। পায়ের নীচে জমি শক্ত নয় বলে সেই ভাবে আমরা প্রতিবাদও করতে পারি না!’’ সাধারণত হিন্দি বা দক্ষিণী ছবি ওটিটি বা টিভিতে মুক্তির আগে স্থানীয় ভাষায় ডাবিং করানো হয়। দেবশ্রীর যুক্তি, ‘‘আমরা তো ছবিটা একই দিনে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির কথা মাথায় রেখেই অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলাম। ওটিটিতেই যদি বাংলার প্রয়োজন হয়, তা হলে তো পরেও ডাবিং করানো যেত। এতটা তাড়ার প্রয়োজন ছিল না।’’ উল্লেখ্য, ছবিতে ফওয়াদ ফাসিলের কণ্ঠ ডাব করেন অর্ঘ্যমাল্য। জানা যাচ্ছে, ‘পুষ্পা ২’-এর ডাবিং শিল্পীরা এখনও পারিশ্রমিক পাননি। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রাপ্য পারিশ্রমিক পেয়ে যাবেন বলেই জানালেন অনেকে।

ইন্ডাস্ট্রিতে গুঞ্জন, ‘পুষ্পা ২’ নাকি ইউরোপের কয়েকটি দেশ এবং বাংলাদেশে বাংলায় মুক্তি পেয়েছে। তবে তা নিয়ে এখনও কোনও নিশ্চিত তথ্য জানা যাচ্ছে না। এ রাজ্যে ‘পুষ্পা ২’-এর পরিবেশনার দায়িত্বে রয়েছেন বাবলু দামানি। ছবিটি কেন বাংলা ভাষায় মুক্তি পেল না, তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট কারণ তাঁর জানা নেই। বললেন, ‘‘ছবির ব্যবসা ভাল হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় কেন মুক্তি পায়নি, তা নিয়ে আমার কাছে কোনও তথ্য নেই। এটা নির্মাতারাই ভাল বলতে পারবেন।’’

‘পুষ্পা ২’-এর ব্যবসা নিয়ে বাংলার হল মলিকেরা খুশি। তবে ইন্ডাস্ট্রিতে খোঁজ নিয়ে সমস্যার অন্য চিত্রও উঠে আসছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হলমালিক বললেন, ‘‘হিন্দি ছবি বাংলায় ডাব করে মুক্তির ক্ষেত্রে আগেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। টলিপাড়ার একাংশই বিরোধিতা করে। তাই কেউ আর ঝুঁকি নেন না।’’

কিন্তু কেন? ওই হলমালিকের যুক্তি, ‘‘এখানকার শিল্পীদের একাংশই তো বিরোধিতা করেন। হিন্দি বা দক্ষিণী ভাষার ছবি বাংলায় মুক্তি পেলে, বাংলা ছবির বাজার নষ্ট হবে। কারণ ওই রকম ছবি তো বাংলায় তৈরি করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের ছবিতে তো বাংলায় টেকনিশিয়ানদের শ্রম নেই। ফলে তাঁদের একাংশ বিরোধিতা করেন।’’

সমস্যার সূত্রপাত নাকি যশরাজ ফিল্মস প্রযোজিত ‘গুন্ডে’ ছবিটিকে কেন্দ্র করে। ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রণবীর সিংহ, অর্জুন কপূর এবং প্রিয়ঙ্কা চোপড়া। কলকাতার প্রেক্ষাপটে গল্প বলে, ছবিটি হিন্দির পাশাপাশি বাংলাতেও মুক্তির পরিকল্পনা করেন নির্মাতারা, কিন্ত শেষ পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রির একাংশ সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। তা সত্ত্বেও বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহে বাংলা ভাষাতেই মুক্তি পায় ‘গুন্ডে’। শহরের এক পরিবেশকের কথায়, ‘‘দশ বছর আগে বাংলা ছবি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা আর বর্তমান সময়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তা ছাড়া বাঙালি তো অন্য কাউকে জায়গা ছাড়তে পছন্দ করে না। ফলে যা হওয়ার সেটাই হয়েছে।’’

এরই পাশাপাশি অন্য তথ্যও উঠে আসছে। ইন্ডাস্ট্রির একাংশের মতে, বাংলায় ডাব করে ছবি মুক্তি তখনই যুক্তিযুক্ত, যখন ছবিকে নির্মাতারা আরও প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে দিতে চান বা ছবি নিয়ে আলাদা কৌতূহল তৈরি করার প্রয়োজন। কিন্তু ‘পুষ্পা ২’ ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি হওয়ায় শুরু থেকেই ছবি নিয়ে আগ্রহ ছিল। সেখানে বাংলায় ভাষায় ছবি মুক্তি পেলে ব্যবসার অঙ্কে খুব বেশি পার্থক্য হত না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবেশকের যুক্তি, ‘‘বাংলায় মুক্তি মানে, আলাদা প্রচার, প্রদর্শনের খরচ। কিন্তু বাংলার দর্শক হিন্দিতেই দক্ষিণী ছবি দেখতে বেশি পছন্দ করেন। ফলে বাংলা ভাষায় মুক্তি পেলে সেই খরচ কি ফিরে আসত?’’

বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের বক্স অফিসে সব ভাষা মিলিয়ে প্রায় ৬৯০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে ‘পুষ্পা ২’। দুঃখের বিষয় সেখানে বাংলা ভাষা অনুপস্থিত। ভবিষ্যতে কোনও বড় প্রজেক্ট কি আদৌ বাংলায় ডাব করা হবে? উঠছে প্রশ্ন। সেই সঙ্গে আগামী দিনে দক্ষিণী ছবির বাংলা সংস্করণ নিয়েও যে ধোঁয়াশা রয়ে গেল, তা আদৌ কাটবে কি না, তার উত্তর পাওয়াও বেশ কঠিন।

Advertisement
আরও পড়ুন