Bengali films on international platform

কান, বার্লিন, ভেনিসে নেই বাংলার ছবি! কেন? অনুসন্ধানে আনন্দবাজার অনলাইন

গত কয়েক দশকে বিশ্বের প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা ছবির উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নেই। অতীতচারী হয়েই কি বাঙালির স্বপ্ন শেষ? আত্মতুষ্টিই ভরসা, না কি দরকার আত্মবিশ্লেষণ? পরিস্থিতি জরিপ করল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement
অভিনন্দন দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২৪ ০৭:৫৯
A comparative analysis behind the reason of absence of Bengali films in renowned international film festivals

(বাঁ দিক থেকে) গৌতম ঘোষ, বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়, শেখর দাশ, আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ও অতনু ঘোষ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

বাঙালি উদ্‌যাপনে থাকে, উদ্যোগে নেই! সম্প্রতি ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘আন সার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন ‘শেমলেস’ ছবির অনসূয়া সেনগুপ্ত। নতুন করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মঞ্চে বাঙালির বড় সাফল্য। কয়েক বছর আগে শৌনক সেন পরিচালিত তথ্যচিত্র (অল দ্যাট ব্রিদস) কানে ‘গোল্ডেন আই’ পুরস্কার জেতে। কিন্তু দীর্ঘ দিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতীয় বাংলা ছবির অনুপস্থিতি বিভিন্ন মহলে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। কান, বার্লিন, ভেনিসের মতো বিশ্বের প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা ছবির অনুপস্থিতির নেপথ্যে কী কী কারণ রয়েছে? কোন পথে হাঁটলেই বা কমতে পারে দূরত্ব? মতামত জানালেন বাংলার চলচ্চিত্র জগতের ছ’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

Advertisement

বিশ্বের প্রথম সারির বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে গৌতম ঘোষ পরিচালিত একাধিক তথ্যচিত্র এবং ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এসেছে পুরস্কার। গৌতমের মতে, চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে শুরুর দিন থেকেই বাঙালি পরিচালকেরা দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। তাঁর কথায়, ‘‘সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন উৎসাহী ছিলেন। রাজ কপূর তাঁর ছবি রাশিয়াতে দেখানো হলে খুব খুশি হতেন। আবার তরুণ মজুমদার বা তপন সিংহ কিন্তু সেই ভাবে চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে উৎসাহী ছিলেন না। অথচ তাঁরা কী অসাধারণ সব ছবি পরিচালনা করেছেন!’’

অন্য দিকে, চলচ্চিত্র উৎসবে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে আয়োজকদের দৃষ্টিভঙ্গির দিকেও নির্দেশ করলেন গৌতম। তাঁর কথায়, ‘‘বিভিন্ন সময়ে আয়োজকেরা এক একটি দেশের ছবিকে প্রাধান্য দেন। কখনও ইরান, কখনও কোরিয়া, আবার হয়তো কখনও ভারত।’’ গৌতম অবশ্য এর মধ্যে কোনও দোষ দেখেন না। বরং জানালেন, এই ভাবে বহু ছবি আন্তর্জাতিক স্তরে আবিষ্কৃত হয়েছে।

ছবি নির্বাচিত হলেই হবে না, তার পরেও ছবিকে আরও পরীক্ষা দিতে হতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিদেশি সহ-প্রযোজনার উপর জোর দিলেন গৌতম। তাঁর কথায়, ‘‘আমার নতুন ছবিটির (‘পরিক্রমা’) অন্যতম প্রযোজনা সংস্থা ইতালির। তাই আশা করি, সে দেশের কোনও বড় উৎসবে ছবিটার প্রিমিয়ার হবে।’’ ডিজিটাল প্রযুক্তি আসার পর এখন উৎসবে ছবির সংখ্যা অজস্র। তাই সব ছবি দেখা অত্যন্ত কঠিন। গৌতম জানালেন, বিভিন্ন ছোট ছোট দলে ছবিগুলো ভাগ করে দেওয়া হয়। তার পর নির্বাচন। তাঁর কথায়, ‘‘ফলে কে বা কারা দেখছেন, বোঝা অত্যন্ত কঠিন।’’ কথা প্রসঙ্গেই অন্য উদাহরণ দিলেন গৌতম। স্পষ্ট হল সময়ের সঙ্গে উৎসবের পরিচালন পদ্ধতির বদল। কানে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিটি প্রতিযোগিতা বিভাগে জমা দিয়েছিলেন গৌতম। পরিচালক বললেন, ‘‘মৃণালদাকে (মৃণাল সেন) উৎসব কর্তৃপক্ষ বলেন, আমার ছবিটার দৈর্ঘ্য ২০ মিনিট কমালে প্রতিযোগিতা বিভাগে রাখা হবে। আমার তখন অল্প বয়স, রাজি হইনি। ফলে ছবিটা ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইটে নিয়ে নেওয়া হয়।’’ পরিচালকের মতে, এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই ব্যক্তিগত স্তরের আলোচনার অবকাশ পাওয়া কঠিন।

A still from the film Padma Nadir Majhi

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবির একটি দৃশ্যে (বাঁ দিকে) চম্পা ও রাইসুল ইসলাম আসাদ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

গৌতমের মতে, বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা পেতে আধুনিক বাংলা ছবিকে শিকড়ে থেকেই আরও আন্তর্জাতিক হতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘কান, বার্লিন বা ভেনিস চিরকাল চলচ্চিত্রের ভাষা এবং নতুনত্বের উপর গুরুত্ব দেয়। সেখানে তারকা কিংবা বাজেট গৌণ হয়ে যায়।’’ একই সঙ্গে তিনি যোগ করলেন, ‘‘আমি যে খুব মহান ছবি করেছি, তা নয়। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরেও যাতে ছবির গুণমান গ্রহণযোগ্য হয়, সেই প্রচেষ্টাই করেছি।’’

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ইতিহাস এবং তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি আলোকপাত করতে চাইলেন চলচ্চিত্রবিদ্যার গবেষক ও অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘দেবকীকুমার বসুর ‘সীতা’ ভেনিসে পুরস্কৃত হয়েছিল। কারণ অনুমেয়, ভারতীয় নারী সম্পর্কে পাশ্চাত্যের কাছে একটা ধারণা তুলে ধরে ছবিটি।’’ একই সঙ্গে তিনি যোগ করলেন, ‘‘মুসোলিনি ভেনিস উৎসব তৈরি করেছিলেন। সেখানে তিনি প্রাচ্যের ছবির উপর জোর দিয়েছিলেন।’’ উদাহরণস্বরূপ সঞ্জয় কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উল্লেখ করলেন। বললেন, ‘‘কানের বিপরীতে এই উৎসব তৈরি করে সোভিয়েত ব্লক। সেখানে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ব্লকের যোগসূত্র তৈরি ছিল অন্যতম লক্ষ্য। সেখানেই তো মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবিটি পুরস্কৃত হয়।’’

সত্যজিৎ, মৃণাল এবং ঋত্বিক পরবর্তী কালের বাংলা ছবির সার্বিক পতন অনস্বীকার্য বলেই মনে করেন সঞ্জয়। সময়ের সঙ্গে চলচ্চিত্র উৎসবকেও বিবিধ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে ভারতের বাজার ধরতে পুরস্কার কখনও কখনও পক্ষপাতদুষ্টও হতে পারে বলেই মনে করেন সঞ্জয়। তিনি বললেন, ‘‘সিনেমার শিল্পমূল্যের মাপকাঠিও তো বদলে গিয়েছে। জুরিতে এখন শিল্পী থাকেন কম, কর্পোরেট সংস্থার প্রতিনিধি থাকেন বেশি। কিন্তু তার মানে এমন নয় যে, ঘরে ঘরে ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘সুবর্ণরেখা’ তৈরি হচ্ছে!’’

A comparative analysis behind the reason of absence of Bengali films in renowned international film festivals

ছবি: সংগৃহীত।

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছতে ছবির প্রচারের উপর আরও বেশি জোর দেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করছেন সঞ্জয়। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক পরিচালকের কাছেই বিষয়টা স্পষ্ট নয়। আবার বিদেশি উৎসবের কর্তাব্যক্তিরা সেই ভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে আসেন না। ফলে ভারতীয় ছবি প্রসঙ্গে যথেষ্ট ‘এক্সপোজ়ার’ও তাঁদের নেই।’’ সঞ্জয়ের মতে, উৎসব সম্পর্কে সকলের সম্যক জ্ঞান নেই বলেও অনেকে তার সুবিধা নেন। বললেন, ‘‘কানে মূল উৎসবের চৌহদ্দির বাইরে তাঁবু খাটিয়ে ছবি দেখিয়ে প্রচার করা হচ্ছে, ‘ছবিটা কানে দেখানো হচ্ছে’! এটা ঠিক নয়।’’ একই সঙ্গে তিনি টলিপাড়ার দিকেও আঙুল তুললেন। সঞ্জয় বললেন, ‘‘কয়েক দিন হলে চলবে বা বিদেশে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় দেখানো হবে এবং তার পর স্যাটেলাইট স্বত্ব— বাংলা ছবিকে এই ছক থেকে বেরোতে হবে। তা না হলে মুশকিল।’’

পরিচালক অতনু ঘোষের একাধিক ছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হয়েছে। অতনু স্বীকার করছেন, বাংলা ছবির আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে উপস্থিতি এখন প্রায় নেই। কিন্তু তাঁর পাল্টা যুক্তি, ‘‘অভিযোগ করা বা সমাজমাধ্যমে লেখা সহজ। কিন্তু একটা ছবিকে কী ধরনের লড়াই করে এই সব উৎসবে পৌঁছতে হয়, সেটা অনেকেই জানেন না।’’ এই প্রসঙ্গে তাঁর শ্লেষ, ‘‘সবাই যেন ধরেই নেন, কান, বার্লিন বা ভেনিসে বাংলা ছবির জন্য একটা দরজা রয়েছে। অথচ প্রতি বছর আমরা সেটা ব্যবহার করছি না!’’

সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবগুলির পরিচালনের ক্ষেত্রে অজস্র কৌশলগত পরিবর্তন ঘটেছে। তাই সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের যুগের সঙ্গে বর্তমান সময়কে গুলিয়ে ফেলতে চাইছেন না অতনু। তিনি বললেন, ‘‘কানে সব মিলিয়ে প্রতি বছর হয়তো ১০ হাজার ছবি জমা পড়ে। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক ছবি কি নির্বাচকদের পক্ষে দেখা সম্ভব? এ রকমও দেখেছি যে, কোনও উৎসবে একটি ছবি হয়তো এক বারও দেখা হয়নি! উৎসব কর্তৃপক্ষও নিরুপায়।’’ অতনু জানালেন, ছবির সংখ্যা কমাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবে এখন আন্তর্জাতিক যৌথ প্রযোজনার উপর জোর দেওয়া হয়। দেখা হয়, কোন কোন দেশের এজেন্ট বা কিউরেটর সেই ছবির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তাই শুরু থেকে বা চিত্রনাট্যের স্তর থেকেই পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। হাতে তিন-চার বছর সময় রাখতে হবে। এই সময় বা ধৈর্য এখন তো আমাদের অনেকের মধ্যেই নেই। বরং বলা ভাল, বাংলায় যে লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখে কাজ হয়, সেখানে চাইলেও করার সুযোগ নেই।’’

A comparative analysis behind the reason of absence of Bengali films in renowned international film festivals

ছবি: সংগৃহীত।

অতনু মনে করেন যে, কোনও ছবির গুণগত মানের নেপথ্যে চিত্রনাট্যের বড় ভূমিকা থাকে। বললেন, ‘‘সারা পৃথিবী জুড়ে চিত্রনাট্যের উৎকর্ষ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। অথচ চিত্রনাট্য লেখার কৌশল শেখার বিষয়ে আমরা বরাবরই উদাসীন। মালয়ালাম বা তামিল ছবি সেখানে বাংলা ছবির থেকে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে।’’

টলিপাড়ার বর্ষীয়ান পরিচালক এবং কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের নির্বাচন কমিটির সদস্য শেখর দাশ বিশ্বের প্রথম সারির বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা ছবির অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাঁর কথায়, ‘‘ভাল বাংলা ছবি তৈরি হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেই বিতর্কে প্রবেশ করতে চাই না। তবে আমি দেখছি, বিগত দু’দশকে তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশের ছবি দ্রুত উন্নতি করেছে। যেখানে তাঁদের সমাজ জীবনের মৌলিক দিকগুলো জায়গা করে নিয়েছে, যা দর্শক এবং নির্বাচকদের মুগ্ধ করছে।’’

শেখরের মতে, ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যাবে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় ছবি তার সেরা সময় কাটিয়ে এসেছে। এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে, বিশেষ করে কান, ভেনিস জাতীয় বড় মাপের উৎসবে সুবিধা করতে পারছে না। তাঁর যুক্তি, ‘‘তারকভস্কির (আন্দ্রেই তারকভস্কি) বা সোকুরভের (আলেকজ়ান্ডার সোকুরভ) পর আর কোনও রুশ পরিচালকের ছবি সেই ভাবে কানে হইচই ফেলতে পারেনি।’’ একই ভাবে ভারতীয় ছবির পরিস্থিতিও ব্যখ্যা করলেন শেখর। বললেন, ‘‘পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সত্যজিৎ ও মৃণাল লড়েছেন। এমনকি তপন সিংহও ছিলেন। পরে সত্তর থেকে নব্বইয়ের মধ্যে আবার বুদ্ধদা (বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত) ও গৌতম ঘোষ লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।’’

A comparative analysis behind the reason of absence of Bengali films in renowned international film festivals

ছবি: সংগৃহীত।

তবে শুধুই অতীত নয়, সমকালীন পরিচালকদের একাংশকে নিয়েও তিনি গর্বিত। শেখরের কথায়, ‘‘এখন আবার আদিত্য (পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত) বা অমর্ত্যদের (পরিচালক অমর্ত্য ভট্টাচার্য) দেখতে পাচ্ছি। আসলে এক একটা ভাল সময় আসে।’’ শেখরের মতে, বিগত তিন দশকে ইরান, তাইল্যান্ড, তুরস্ক বা দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নজর কেড়েছে। ফলে বাংলা ছবির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আরও বেড়েছে। শেখরের কথায়, ‘‘আজ়গর ফারহাদি (ইরানের পরিচালক) বা নুরি বিলজে সিলান (তুরস্কের পরিচালক) তো চলচ্চিত্র উৎসব থেকেই উঠে এসেছেন।’’

শেখরের মতে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বাংলা ছবি’ নয়, বরং ভারতীয় ছবি হিসেবেই নির্বাচকরা ছবিটিকে বিচার করেন। তাঁর কথায়, ‘‘ধরা যাক, ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষার ১০টি ছবি জমা পড়েছে। আমি যদি বাকি ভাষার ছবিগুলিকে উৎকর্ষের গুণে না হারাতে পারি, তা হলে তো আমি সুযোগ পাব না।’’

বিজ্ঞাপন জগতে বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়ের কাজ চর্চিত। পাশাপাশি তাঁর ছবিও আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমাদৃত হয়েছে, যার মধ্যে ‘তিনকাহন’ ও ‘দ্য ভায়োলিন প্লেয়ার’ অন্যতম। বৌদ্ধায়ন স্পষ্ট বললেন, ‘‘মধ্যমেধার ছবি পৃথিবীর কোনও প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় না। তাই বাংলা ছবি দেখানো হচ্ছে না বলে আমাদের কষ্ট পাওয়ারও কোনও কারণ নেই!’’ বৌদ্ধায়নের মতে, বাংলা ছবির গুণগত উন্নতির জন্য কিছু করা হচ্ছে না। তাঁর কথায়, ‘‘অনুরাগ কাশ্যপ কলকাতায় আসার পর, বাংলা ছবি সম্পর্কে তাঁর মতামত শুনে আমরা অভিমান করতে পারি। কিন্তু, আমরা আত্মবিশ্লেষণ কি করব না?’’

প্রযুক্তি, বিষয়বস্তু, না কি বিশ্ব সিনেমা সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান— কোন বিষয়টা বাংলা ছবির আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছনোর পথে অন্তরায় হয়ে উঠছে, তা আগে খতিয়ে দেখতে হবে বলেই জানালেন বৌদ্ধায়ন। বিদেশি ছবির শিল্পগত গুণমাণ সম্পর্কে অবগত না হলে, বাংলায় একই ছবিই বার বার তৈরি করা হবে এবং তা সমকালীন ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা’-র থেকে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে থাকবে বলেই মনে করেন তিনি। বৌদ্ধায়ন বললেন, ‘‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে নির্মাতাদের সারা বিশ্বের ছবি সম্পর্কে একটা সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। শুধু ক্রিস্টোফার নোলান নয়, পাশাপাশি জ়ায়রো বুস্তামান্তে বা লাভ দিয়াজ়ের ছবিও দেখতে হবে।’’

A comparative analysis behind the reason of absence of Bengali films in renowned international film festivals

ছবি: সংগৃহীত।

বড় চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছতে হলে বিষয়ভাবনার মধ্যেও নতুনত্ব বজায় রাখার কথা বললেন বৌদ্ধায়ন। তাঁর কথায়, ‘‘নিজস্ব গল্প, ব্যক্তিগত রাজনীতির কথা বলতে হবে এবং নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে হবে। তার থেকেও বড় কথা, ব্যবসার ঊর্ধ্বে ছবিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। আদিত্য (পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত) তো সেটাই করে প্রমাণ করেছে।’’

এখানেই শেষ নয়। প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছতে পদ্ধতিগত দিকটিকেও তুলে ধরলেন পরিচালক। বৌদ্ধায়নের কথায়, ‘‘চিত্রনাট্য নিয়ে বিদেশের স্ক্রিপ্ট ল্যাবে যেতে হবে। সেখান থেকে যৌথ প্রযোজনার দরজা উন্মুক্ত হবে।’’ একই সঙ্গে বললেন, ‘‘এনএফডিসি বেশ কিছু দেশের সঙ্গে সিনেমা নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তার সুবিধা নিতে হবে।’’ ইচ্ছে এবং প্রচেষ্টা থাকলে একদিন সাফল্য আসবেই বলে বিশ্বাস করেন বৌদ্ধায়ন। কিছুটা আক্ষেপের সুরেই বললেন, ‘‘আমরা যত দিন ‘স্যানিটাইজ়ড’, ‘অ্যাপলিটিক্যাল’ এবং ‘নন-পার্সোনাল’ ছবি তৈরি করে যাব, তত দিন ভারতীয় বাংলা ছবি বিশ্বের প্রথম সারির কোনও চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হবে না। ব্যবসা হবে, স্টারডম হবে, কিন্তু কান, বার্লিন, ভেনিস হবে না! সিদ্ধান্ত একান্তই পরিচালকের নিজস্ব।’’

পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের তিনটি ছবিই একাধিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে। তবে প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছনোর পথ যে ইদানীং ‘কঠিন’, তিনি তা মানতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ ছবিটির উদাহরণ দিলেন। ২০১৪ সালে ছবিটি ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং আদিত্য সেরা ডেবিউ পরিচালকের পুরস্কার জেতেন। আদিত্য বললেন, ‘‘আমি কাউকে চিনতাম না। বাড়ির সামনে পাড়ার মোড় থেকে ডিভিডি কুরিয়্যার করেছিলাম। তার পর জানতে পারি, ছবিটা নির্বাচিত হয়েছে।’’ উল্লেখ্য, এই উৎসবেই আদিত্যের সাম্প্রতিক ছবি 'ওয়ান্স আপঅন আ টাইম ইন ক্যালকাটা'র ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়।

A comparative analysis behind the reason of absence of Bengali films in renowned international film festivals

‘আসা যাওয়ার মাঝে’ ছবির একটি দৃশ্যে বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায় এবং ঋত্বিক চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবে পৌঁছনোর কোনও সহজ রাস্তা নেই বলেই মনে করেন আদিত্য। কিন্তু পদ্ধতি রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মনে হয়, যাঁরা ছবি তৈরি করেন, সেই প্রযোজক বা পরিচালকেরা এই ধরনের উৎসবের কিউরেটরদের খুব ভাল করেই চেনেন।’’ তবে আদিত্যের মতে, সবার আগে নিজের শিল্পের গুণগত মানের উপর জোর দিতে হবে। তা ঠিক থাকলে দরজা নিজে থেকেই খুলে যায়। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলগুলো কয়েক মাস ধরে যত্ন নিয়ে তৈরি হয়। কোনও প্যান্ডেল দু’সপ্তাহে তৈরি হলে নিশ্চয়ই সেটা সেরার পুরস্কার পাবে না!’’

আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলা ছবি যে এখন খুব একটা সুবিধার জায়গায় নেই, তা স্পষ্ট। বাংলা ছবির সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার পথ কঠিন হতে পারে, কিন্তু তা অসম্ভব নয়। প্রস্তুতি, পরিশ্রম এবং সর্বোপরি শিল্পের প্রতি সততা যাবতীয় বাধা অতিক্রমের অন্যতম শর্ত। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ভাবনার মৌলিকতা। ‘বাংলা ছবি’ আর ‘বাংলার ছবি’— এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক রয়েছে। বিদেশি পরিচালকও বাংলার প্রেক্ষাপটে ছবি করতে পারেন। কিন্তু তাকে কতখানি ‘বাংলার ছবি’ বলা যায়, তা তর্কের বিষয়। বঙ্গ পরিচালকদের সামনে অর্থাভাব রয়েছে, উন্নততর প্রযুক্তির অভাবও রয়েছে। সে সব অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হতে গেলে আবার শুধু বিনিয়োগ দিয়েও কাজ হবে না। কোথাও খামতি থেকেই যাচ্ছে একটা ‘ব্রেক থ্রু’-এর। গত তিন দশকে বাংলা ছবি অনেকাংশেই ‘ড্রইংরুম সিনেমা’। একটা বিশেষ শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখে বিশেষ আঙ্গিকে, বিশেষ ব্যাকরণে নির্মিত। সেই দেওয়াল না ভাঙতে পারলে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে জায়গা পাওয়া দুরূহ। নির্মাতাদের বোধ হয় সময় এসেছে এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার।

আরও পড়ুন
Advertisement