Lok Sabha Election 2024

সকলেরই চাই সোনার হরিণ কুড়মি ভোট! ছয় মাহাতোর লড়াই পুরুলিয়ায়, ময়দানে মাহাতো সমাজের নেতাও

পুরুলিয়া আসনের প্রধান প্রার্থীরা সকলেই মাহাতো। আবার যদি এই লোকসভার ইতিহাস দেখা যায়, তা হলে বোঝা যাবে, সব দলের হয়েই কুড়মি সম্প্রদায়ের কেউ না কেউ সংসদে গিয়েছেন। এ বার লড়াই কুড়মি বনাম কুড়মিরই।

Advertisement
পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৪ ২০:০০
What is the political situation of Purulia constituency before Lok Sabha Election 2024

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পুরুলিয়া লোকসভা আসনে বিজেপির প্রার্থী বিদায়ী সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো। তৃণমূল প্রার্থী রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো। কংগ্রেস প্রার্থী করেছে অতীতে চার বারের বিধায়ক নেপালদেব মাহাতোকে। দীর্ঘ দিন এই আসনের ‘দখলদার’ ফরওয়ার্ড ব্লকের (ফব) প্রার্থী আবার ধীরেন্দ্রনাথ মাহাতো। তবে সেখানেই শেষ নয়, পুরুলিয়ায় এসইউসিআইয়ের প্রার্থীর নাম সুস্মিতা মাহাতো। সেই সঙ্গে নির্দল হয়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন রাজ্যের আদিবাসী কুড়মি সমাজের মূল মানতা অজিতপ্রসাদ মাহাতো।

Advertisement

মাহাতোরা কুড়মি। সেই ভোট নিজেদের বাক্সে টানতে ‘কুড়মি মুখ’ খোঁজার লড়াই পুরুলিয়ায় ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। কোনও সময়েই এই কেন্দ্রে কুড়মি সম্প্রদায়ের বাইরে প্রার্থী করার ঝুঁকি নিতে চায় না কোনও দল। ১৯৬২ সালে প্রথম বার মাহাতো সাংসদ পায় পুরুলিয়া। আর থামেনি। সে বারে লোকসেবক সঙ্ঘের ভজহরি মাহাতো থেকে কংগ্রেসের দেবেন্দ্রনাথ মাহাতো, ফব-র চিত্তরঞ্জন মাহাতো পর পর সাংসদ হয়েছেন। পাঁচ বার চিত্তরঞ্জন জেতার পরে ফব-র বীরসিং মাহাতো আরও চার বার। পরে ফব-র নরহরি মাহাতো। সেই নরহরিই এখন জয়পুরের বিজেপি বিধায়ক। যে জয়পুর কেন্দ্রটি ভৌগোলিক ভাবে বাঁকুড়া জেলায় হলেও লোকসভা কেন্দ্রের হিসেবে পুরুলিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ২০১৪ সালে জয়ী তৃণমূলের মৃগাঙ্ক মাহাতো। সর্বশেষ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো। জয়ীরাই শুধু নন, এই সব বছরে পরাজিত বড় থেকে ছোট দল বা নির্দল প্রার্থীদের বেশির ভাগও ছিলেন কুড়মি সমাজের মাহাতো।

স্বাভাবিক। কারণ, এই আসনের মোট ভোটারের এক-তৃতীয়াংশ কুড়মি জনজাতির। এর পরে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় (ওবিসি) সম্প্রদায়ের ভোটও ৫০ শতাংশের বেশি। বাকি ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু এবং সাধারণ শ্রেণি। বছরের পর বছর পুরুলিয়া দিল্লিতে কুড়মি সাংসদ পাঠালেও এই সম্প্রদায়ের জাতিসত্তার দাবি এখনও মেটেনি। সেটা তুলে ধরতেই সরাসরি আদিবাসী কুড়মি সমাজের নেতা অজিত নির্দল প্রার্থী হয়েছেন।

What is the political situation of Purulia constituency before Lok Sabha Election 2024

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

এই আসন সব চেয়ে বেশি সময় ফব-র হাতে থাকলেও জোটের শরিক কংগ্রেসকে এই আসনটি এ বার ছেড়ে দিয়েছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু ফ্রন্টের আপত্তির তোয়াক্কা না করেই ফ্রন্টের শরিক ফব পুরুলিয়ায় প্রার্থী দিয়ে দিয়েছে। ফলে এই আসনে জোট হয়েছে বলা যাবে না। বিজেপি তাই প্রচারে বলছে, পুরুলিয়া কেন্দ্রে সর্বভারতীয় জোট ‘ইন্ডিয়া’-র তিন দল প্রার্থী দিয়েছে। কংগ্রেস, তৃণমূল এবং ফব।

বামফ্রন্টের সিদ্ধান্ত ভেবে ফব এই আসনে প্রার্থী দিলেও পুঁজি কিছু নেই। পাঁচ বছর আগে এই আসন থেকে ৫.০৫ শতাংশ ভোট পেয়ে তারা চতুর্থ হয়েছিল। তৃতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেসের হাতে ছিল একটু বেশি— ৬.২৩ শতাংশ ভোট। রাজ্যে পালাবদলের পরে পুরুলিয়ায় ফব-র দিন যে শেষ, তার ইঙ্গিত মিলেছিল ২০১৪ সালের ভোটেই। তৃণমূলের চিকিৎসক প্রার্থী মৃগাঙ্কের কাছে দেড় লাখের বেশি ভোটে পরাজিত হন ফব-র নরহরি। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ২৬ শতাংশের মতো। কংগ্রেসের নেপাল পেয়েছিলেন ২১.৪১ শতাংশ ভোট। এর পরে ২০১৯ সালে ভোটের ফল একেবারে বদলে যায়। জঙ্গলমহলে পদ্ম ফোটান ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে বাঘমুন্ডিতে তৃতীয় হওয়া জ্যোতির্ময়। ৪৯.৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃণমূলের মৃগাঙ্ককে হারান দু’লাখের বেশি ভোটে। এক লাফে বিজেপির ভোট বেড়েছিল ৪২.১৫ শতাংশ।

এ বার দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে প্রধান তিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বিজেপি, কংগ্রেস এবং তৃণমূল আছে। আছেন দুই দলের প্রার্থী হিসেবে যথাক্রমে জ্যোতির্ময় এবং নেপালদেব। কিন্তু মৃগাঙ্ককে আর প্রার্থী করেনি তৃণমূল। তাঁর পরিবর্ত হিসাবে আনা হয়েছে পুরুলিয়া জেলার অভিজ্ঞ রাজনীতিক শান্তিরামকে। বাংলার রাজনীতিতে পোড়খাওয়া শান্তিরাম অল্প বয়সেই জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা শান্তিরাম ১৯৭২ সালে মানবাজার থেকে কংগ্রেসের টিকিটে বিধায়ক হন। তার পর ধারাবাহিক পরাজয়ের পরে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে কংগ্রেসের প্রতীকেই বিধানসভায় ফিরেছিলেন। কিন্তু ২০০৬ সালে বামফ্রন্টের প্রবল ঝড়ে ধরাশায়ী হন শান্তিরাম। আবার ২০০৯ সালে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট প্রার্থী হিসাবে ‘হাত’ প্রতীকে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন। তার পরেই কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যান শান্তিরাম।

২০১১ এবং ২০১৬ সালে বলরামপুর থেকে বিধায়ক হন শান্তিরাম। দু’বারই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন এই প্রবীণ নেতা। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বাণেশ্বর মাহাতোর কাছে পরাজিত হন। নীলবাড়ির লড়াইয়ে শুধু বাঘমুণ্ডি আর মানবাজার বিধানসভা জিতেছিল তৃণমূল। আর গত লোকসভা ভোটে বিজেপি পিছিয়ে ছিল শুধুই মানবাজারে। তবে বাঘমুণ্ডিতে নীলবাড়ির লড়াইয়ে প্রার্থী ছিল না পদ্মের। এই আসনটি এনডিএ-র শরিক এজেএসইউ (অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন)-কে ছেড়েছিল বিজেপি।

ছাত্রাবস্থায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) এবং অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের কর্মী জ্যোতির্ময় এখন রাজ্য নেতা। দিলীপ ঘোষ জমানার পরে সুকান্ত মজুমদারের টিমেও অন্যতম সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন তিনি। পুরুলিয়ায় তাদের সহজ জয় হবে বলেই ভাবছে বিজেপি। কারণ, কুড়মি তো বটেই, দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করার পরে অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভোটও পদ্মে আসবে বলেই তাদের আশা। অন্য দিকে, তৃণমূল মনে করছে, এ বার কুড়মি ভোট তাদের দিকেই যাবে।

কিন্তু তার বাইরেও একটা ভাবনা রয়েছে— এত জন মাহাতো প্রার্থীতে কুড়মি ভোট ভাগ হয়ে যাবে না তো! হলে কাটাকুটির অঙ্কে কে টিকে থাকবেন?

আরও পড়ুন
Advertisement