গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
স্বাধীনতার পরে দু’বার কংগ্রেস আর এক বার ফরওয়ার্ড ব্লক জিতলেও ১৯৭১ থেকে টানা সিপিএমের দখলে ছিল হাওড়া গ্রামীণ এলাকার উলুবেড়িয়া। হাওড়া জেলারই সাতটি বিধানসভা নিয়ে তৈরি এই লোকসভায় টানা আট বার জিতেছেন সিপিএমের হান্নান মোল্লা। অনেকে তখন এই আসনকে বলতেন ‘হান্নানবেড়িয়া’। যেমন তৃণমূলের জমানায় উলুবেড়িয়া আসলে ‘সুলতানবেড়িয়া’। ২০০৯ সালে হান্নানকে হারিয়েই জিতেছিলেন তৃণমূলের সুলতান আহমেদ। ২০১৪ সালেও জেতেন তিনি। সুলতানের অকালমৃত্যুর পরে এই আসন তাঁর স্ত্রী সাজদা আহমেদের। এ বারেও তিনিই প্রার্থী। উলুবেড়িয়া জানে, সাজদার ক্ষেত্রে ‘সুলতানের স্ত্রী’ পরিচয়টাই প্রধান।
এই আসনের ইতিহাস, জনবিন্যাস, ভোটের অঙ্ক— সবই তৃণমূলের পক্ষে। তবে এ বার লড়াই বিজেপির সঙ্গে দ্বিমুখী না বহুমুখী, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। বিজেপি এখানে খুব উঁচুদরের প্রার্থী দেয়নি। উলুবেড়িয়া সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অরুণ উদয় পালকে প্রার্থী করেছে তারা। অতীতে তো বটেই, ২০১৯ সালেও কংগ্রেসের তুলনায় বামেদের বেশি ভোট ছিল এই আসনে। তবে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়েছেন কংগ্রেসের আজহার মল্লিক। ময়দানে রয়েছেন আইএসএফের প্রার্থীও। ৩০ শতাংশের মতো মুসলিম ভোটারের উলুবেড়িয়ায় ‘খাম’ প্রতীকের মফিকুল ইসলাম কোনও ম্যাজিক দেখাবেন কি না কে জানে! তবে পাল্লা ভারী ঘাসফুলেরই।
উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা হল উলুবেড়িয়া পূর্ব, উলুবেড়িয়া উত্তর, উলুবেড়িয়া দক্ষিণ, শ্যামপুর, বাগনান, আমতা এবং উদয়নারায়ণপুর। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সাতটি আসনেই জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। গত লোকসভা ভোটেও সর্বত্র এগিয়ে ছিল ঘাসফুল। ৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৮৮টিই তৃণমূলের। দু’টি দখল করেছিল সিপিএম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। ন’টি পঞ্চায়েত সমিতি ‘বিরোধীহীন’। তৃণমূলের দখলে। সব মিলিয়ে গোটা উলুবেড়িয়া কেন্দ্রে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। যা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে।
সে বার লোকসভা নির্বাচনে উলুবেড়িয়ায় ‘বাম দুর্গ’ ভেঙে পড়া টের পেয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। আট বারের সাংসদ হান্নানকে প্রায় ১ লক্ষ ভোটে হারিয়ে দিয়েছিলেন সুলতান। যে হান্নান ২০০৪ সালেও লক্ষাধিক ভোট জিতেছিলেন। আবার ২০১৪ সালে জয়। এ বার সিপিএম প্রার্থী সাবিরউদ্দিন মোল্লাকে দু’লক্ষেরও বেশি ভোটে হারান অতীতে কংগ্রেসের টিকিটে দু’বার এন্টালি বিধানসভা আসনে জয়ী সুলতান।
মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ার সময় থেকেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ছাত্র পরিষদ, যুব কংগ্রেসের পরে কংগ্রেসের বিধায়ক। সেই সঙ্গে মহামেডান ক্লাব-সহ অনেক মুসলিম সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুলতান। আবার তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গী। কিন্তু ২০১৬ সালে তৃণমূলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু মুখ সুলতানের নাম জড়িয়ে যায় নারদকাণ্ডে। সিবিআই, ইডির জেরার মুখেও পড়েন। তদন্তাকারীদের ডাক পান তাঁর ভাই ইকবাল আহমেদও। সেই সময়ে শোনা গিয়েছিল, দলের অন্দরেও চাপে রয়েছেন সুলতান। রাজ্যের সংখ্যালঘু বিত্ত কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে হয় তাঁকে। এরই মধ্যে আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুলতানের মৃত্যু হয় ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর।
তৃণমূল ঝুঁকি নেয়নি। ২০১৮ সালের উপনির্বাচনে সুলতানের স্ত্রী সাজদাকে প্রার্থী করে। কারণ, উলুবেড়িয়ার ভোটারদের মনে সত্যিই ‘সুলতান’ ছিলেন দু’বারের সাংসদ। প্রায় পৌনে পাঁচ লক্ষ ভোটে জয় পান সাজদা। আর ২০১৯ সালে ২ লক্ষেরও বেশি ভোটে। সেই উপনির্বাচনেই বিজেপি উলুবেড়িয়ায় দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে। ২৩.২৯ শতাংশ ভোট পান পদ্মপ্রার্থী অনুপম মল্লিক। ২০১৯ সালে বিজেপি প্রার্থী তথা অভিনেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ হয়ে যায় ৩৬.৫৮ শতাংশ। অনেক এগিয়ে থাকা তৃণমূলের ভোট ৫৩ শতাংশ। সিপিএম পায় ৬.২০ শতাংশ এবং কংগ্রেস ২.১০ শতাংশ ভোট।
এ বার তৃণমূল সাজদাতেই ভরসা রাখলেও প্রার্থী বদলে দিয়েছে সব দলই। ‘হাত’-এর প্রার্থী প্রদেশ যুব কংগ্রেস সভাপতি তথা এআইসিসি সদস্য আজহার। বর্ধমানের খণ্ডঘোষের মূল বাসিন্দা হলেও আজহার এখন তাঁর ব্যবসার সূত্রে হাওড়ার বালিতে থাকেন। এমনিতেই ২০১৯ সালের হিসাবে তাঁর পুঁজি কম। তার উপরে ‘কাঁটা’ হয়ে রয়েছেন আইএসএফ প্রার্থী মফিকুল। এক সময়ে ‘আইএমএম’-এর সঙ্গে যোগ থাকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মফিকুল তা অতীত বলেই দাবি করছেন। ভোটের আবহেই ২০২২ সালের 8 অগস্টের একটি চিঠি প্রকাশ্যে আসে। সেই চিঠি অনুযায়ী, এমআইএম-এর সর্বভারতীয় সভাপতি তথা সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বাংলায় দল কী ভাবে চলবে, তার জন্য গঠিত একটি কোর কমিটির সদস্য করেছেন মফিকুলকে। চিঠিতে স্বাক্ষরও রয়েছে ওয়াইসির। যদিও মফিকুল জানিয়েছেন, তাঁর সম্মতি ছাড়াই কোর কমিটির সদস্য করা হয়েছিল তাঁকে। বিতর্ক যতই থাকুক, বিজেপি এবং তৃণমূল দু’পক্ষের অঙ্কেই রয়েছেন আজহার এবং মফিকুল এবং তাঁদের ভোট কাটাকাটি।
তবে এই লোকসভা কেন্দ্রে এ বারের ভোটে বড় ইস্যু হতে পারে ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যু। বরাবর বিজেপি বিরোধী আন্দোলনে সরব ছিলেন এই ছাত্রনেতা। কিন্তু ২০২২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নিজের বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে মারা যান আনিস। তার পরেই পরিবার অভিযোগ করে, গভীর রাতে এসে পুলিশ অত্যাচারে করায় ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছেন আনিস। সেই ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল কলকাতার রাজপথও। আন্দোলনে ভাগ বসাতে চেয়েছিল সিপিএম, কংগ্রেস এবং আইএসএফ। গত বিধানসভা ভোটে এই তিন শক্তি একত্রে লড়াই করলেও এ বারের ভোটে তারা কোনও জোটে নেই। কংগ্রেস-সিপিএমের মধ্যে আসন সমঝোতা হলেও একক ভাবে লড়াই করছে আইএসএফ। প্রথম দিকে বাম রাজনীতির দিকে ঝোঁক থাকলেও শেষের দিকে আনিস ছিলেন আইএসএফের সদস্য। তবে সেই আন্দোলনে কংগ্রেস, সিপিএম এবং আইএসএফের মতো বিজেপিও প্রতিবাদের সরব হয়েছিল। কিন্তু তার রাজনৈতিক ফায়দা তারা পাবে না বলেই অভিমত উলুবেড়িয়ার বাসিন্দাদের একাংশের। বরং সেই ফায়দা যেতে পারে নওশাদ সিদ্দিকির দলের ভোট বাক্সে। কারণ, আনিসের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের পাশে সবরকম ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফুরফুরা শরিফের এই বিধায়ক পিরজাদা। এ রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটে একাধিপত্য তৃণমূলের। কিন্তু উলুবেড়িয়ায় সমীকরণ পৃথক। আনিসের মৃত্যু একটু হলেও চিড় ধরিয়েছে উলুবেড়িয়ার তৃণমূলের সংখ্যালঘুর ভোট বাক্সে। তার প্রমাণ, শাসক শিবিরে সংখ্যালঘুদের ‘অন্যতম মুখ’ ফিরহাদ হাকিমের আনিসের বাড়ি যেতে গিয়ে মাঝপথ থেকেই বাধা পেয়ে ফিরে আসা। আনিসের ‘ক্ষত’ এখনও উলুবেড়িয়ার সংখ্যালঘু মানুষের একাংশের মন থেকে মুছে যায়নি বলেই মনে করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
এ হেন কেন্দ্রে পদ্ম ফোটাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সকলেই এসেছেন। ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগের অঙ্ক কাজে লাগাতে যা যা বলা দরকার, বিজেপির দুই শীর্ষ প্রচারক সবই বলেছেন। স্থানীয় এবং রাজ্য বিজেপি নেতাদের প্রচারেও ‘রামমন্দির’, ‘অযোধ্যা’, ‘হিন্দু-মুসলমান’ শব্দের ঝঙ্কার শোনা যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে রামনবমীর মিছিল ঘিরে এই লোকসভার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত ভাবে সংঘাতের আবহ বড় আকার নিয়েছিল। বিজেপি তা-ও মনে করাতে চাইছে। পাল্লা দিয়ে তৃণমূলও মেরুকরণের তাস ফেলছে। সাহেব, বিবি, গোলাম— সব তাসই দেখিয়ে দিয়েছেন দু’পক্ষের নেতারা। কিন্তু টেক্কা তো ভোটারদের হাতে!