গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাজনৈতিক জীবনের এক দশক পার হয়ে গেলেও প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে এখনও ‘ফুটবলার’। কলকাতা ময়দানের মিডফিল্ডার প্রসূন রাজনীতির মাঝমাঠেও স্বমহিমায়। উপনির্বাচন ধরলে সংসদে যাওয়ার হ্যাটট্রিক হয়ে গিয়েছে। না ধরলে এ বার তাঁর হ্যাটট্রিক করার সুযোগ। গত লোকসভার হিসাব বা ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের ফলাফল অনুযায়ী হাওড়া আসনে তৃণমূল বাকিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। পাঁচ বছর আগে তা-ও বিজেপি একটি বিধানসভা এলাকায় অল্প ভোটে হলেও এগিয়ে ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে সাতে সাত পেয়েছে প্রসূনের দল তৃণমূল।
ঘাসফুল লোকালের এমন সাজানো আসনে বিজেপির বড় ভরসা ‘অযোধ্যা এক্সপ্রেস’। গত ২২ জানুয়ারি নতুন রামমন্দির উদ্বোধনের পরে হাওড়া স্টেশন থেকে অনেক অযোধ্যা এক্সপ্রেস চালিয়েছে পদ্মশিবির। ট্রেনবোঝাই মানুষ গিয়েছেন রামলালা দর্শনে। সেই পুণ্যার্থীদের বড় অংশ হাওড়া লোকসভা এলাকার। কারণ, এই আসনের শহর এলাকায় ২৫ শতাংশের বেশি ভোটার হিন্দিভাষী। তাঁদের দানে বিজেপির ভোটপাত্র ভরবে বলেই মনে করছে পদ্মশিবির। তবে দলের মধ্যেই আলোচনা যে, ‘অর্জুন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রসূনের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসাবে রথীন চক্রবর্তী তত ‘শক্তিশালী’ নন।
রথীনের প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁরই অতীত। মধ্য হাওড়ার বাসিন্দা বিশিষ্ট হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসক ভোলানাথ চক্রবর্তীর পুত্র রথীন ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তৃণমূলের মেয়র ছিলেন হাওড়া পুরসভায়। তার পরে আর কেউ মেয়র হননি। কারণ, হাওড়া পুরসভায় এখনও পর্যন্ত কোনও নির্বাচন হয়নি। রাজ্য সরকার ‘মনোনীত’ প্রশাসকমণ্ডলী হাওড়া পুরসভার দায়িত্বে।
২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রথীন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। টিকিট পেয়েছিলেন শিবপুর কেন্দ্রে। বড় ব্যবধানে হেরেছিলেন ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারির কাছে। সেই হারের পরে তাঁকে রাজনীতির ময়দানে বিশেষ দেখা যায়নি। তবে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলেই বিজেপি সূত্রের খবর। সেই সূত্রের এমনও দাবি যে, সেই যোগাযোগেই লোকসভার টিকিটপ্রাপ্তি।
হাওড়া আসন সেই ১৯৫২ সাল থেকে কখনও কংগ্রেস, কখন বামেদের দখলে থেকেছে। দু’বার সাংসদ হয়েছেন প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। বাম আমলেই ১৯৯৮ সালে প্রথম বার এখানে তৃণমূল প্রার্থী জয়ী হন। জিতেছিলেন প্রাক্তন আমলা বিক্রম সরকার। ২০০০ সালে যিনি তৎকালীন পাঁশকুড়া লোকসভার উপনির্বাচনে সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্তকে হারিয়ে ঘাসফুলের টিকিটে জিতেছিলেন। হাওড়া অবশ্য ১৯৯৯ সালেই সিপিএম পুনরুদ্ধার করে। জিতেছিলেন স্বদেশ চক্রবর্তী। ২০০৯ সালে হাওড়া আবার তৃণমূলের। অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতে নেন হাওড়া। ২০১৩ সালের মে মাসে অম্বিকার মৃত্যুর পরে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন হাওড়ার সাংসদ হন। সেই থেকে তিনিই রয়েছেন।
উপনির্বাচনের মতোই ২০১৪ সালে প্রসূনের বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রার্থী হন শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। বিজেপি প্রার্থী করে অভিনেতা জর্জ বেকারকে। প্রসূন জিতলেও উত্থান দেখা যায় পদ্মের। দ্বিতীয় স্থানে থাকা শ্রীদীপ পান প্রায় তিন লাখ ভোট। তৃতীয় জর্জ পান প্রায় আড়াই লাখ ভোট। ২০১৯ সালে বিজেপি চলে আসে দ্বিতীয় স্থানে। তবে অনেকটা দূরের দ্বিতীয়। তথাকথিত রাজনীতির বাইরের লোক প্রাক্তন সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্তকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। রন্তিদেব হেরেছিলেন লক্ষাধিক ভোটে। তৃণমূল পেয়েছিল ৪৭.১৮ শতাংশ ভোট। রন্তিদেবের ঝুলিতে আসে ৩৮.৭৩ শতাংশ ভোট। তখন একমাত্র এগিয়ে থাকা হাওড়া দক্ষিণ আসনে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপির প্রার্থী হয়ে হারেন রন্তিদেব। এখন অবশ্য বিজেপি তাঁর ঘোর শত্রু।
এ বার এই আসনে জোটের প্রার্থী সিপিএমের সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বয়সে নবীন। আইনজীবী সব্যসাচীর লড়াইয়ের পুঁজি কম। বাম-কংগ্রেস মিলিয়ে গত লোকসভা ভোটে ১১ শতাংশের মতো ভোট ছিল। গত পাঁচ বছরে যে ভোট আরও কমেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
লোকসভা নির্বাচন হলেও হাওড়ার পুর পরিষেবাও সাংসদ বাছার ভোটে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ দিন হাওড়া এবং বালি পুরসভায় ভোট না-হওয়া নিয়ে সরব বিজেপি, সিপিএম। জলাভূমি ভরাট, সিন্ডিকেট রাজের মতো স্থানীয় বিষয়ও উঠে আসছে প্রচারে। সেই সঙ্গে রয়েছে ধর্মীয় মেরুকরণ। ২০২৩ সালের রামনবমীর গোলমাল এখনও স্মরণে রয়েছে হাওড়াবাসীর। সেই হিসাবে রথীনের ভরসা হাওড়া শহরকেন্দ্রিক তিন বিধানসভা। বালি, শিবপুরেও রামনামের ভোট রয়েছে। এ বার দেখার যে, অতীতের মতো প্রসূনকে এ বারেও কি গোলের বল বাড়িয়ে দেবে শহর থেকে দূরের পাঁচলা, সাঁকরাইল! না কি সেখানেও মেরুকরণের আঁচ লাগবে!