ভাঙা হল মুজিবুর রহমানের মূর্তিও। শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর। ছবি: এএফপি।
ফেসবুকে এ সব স্টেটাস দিচ্ছিস? তোকে তো বাংলাদেশ আর ভিসা দেবে না!
সক্কাল সক্কাল সাংবাদিক বন্ধুর উদ্বিগ্ন ফোন। কী কারণ? কেন ভিসা দেবে না? কারণ, তার আগের রাতে ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে ঢাকার শাহবাগে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের চত্বরে হাজার হাজার কণ্ঠে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গাওয়ার ভিডিয়ো শেয়ার করে লিখেছিলাম, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর আন্দোলনে পূর্ণ সংহতি জানাচ্ছি। ইস, যদি ওঁদের সঙ্গে ওইখানে দাঁড়িয়ে গাইতে পারতাম, ‘ও মা, তোমার চরণ দু’টি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতেই জন্ম— যেন এই দেশেতেই মরি..!’
বললাম, হতে পারে আর কখনও ভিসা দেবে না। কিন্তু এটা আমায় করতেই হত। এক ধাপ এগিয়েই বললাম, দ্যাখ, ভিসা যাঁরা দেবেন না, তাঁদের আর সেই ক্ষমতা থাকে নাকি! বলেই মনে হল, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেললাম নাকি? আমি কোথাকার কে খাঞ্জা খাঁ এ সব বলার?
গণ আন্দোলনের ঝাপটায় দিন তিনেক পরে যখন পলায়নপর শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে নিয়ে ঢাকার আকাশে উড়ছে বাংলাদেশ বায়ুসেনার হেলিকপ্টার, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসস্থান গণভবন দখল করে নিয়েছে উন্মত্ত জনতা, তাণ্ডব চালাচ্ছে, নড়েচড়ে বসেছে সারা পৃথিবী, মনে হচ্ছিল, কী কাণ্ড! ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা হয়ে গেলাম নাকি রে বাবা!
মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে এ যাবৎ কোনও অভ্যুত্থানেই কোনও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি দেশ ছেড়ে পালাননি। সে তিনি বেগম খালেদা জিয়াই হোন বা হুসেইন মহম্মদ এরশাদ। জেল খেটেছেন। কিন্তু পালাননি! সে জন্য তাঁরা টিকেও গিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন! সামান্য ভুল হল। শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা পালিয়ে গেলেন!
কত দিন ধরে বাংলাদেশে যাচ্ছি ভুলে গিয়েছি। তবে মনে ছিল যে, প্রথম যাওয়া ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তির সময়। তখন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া। তিনি যাবেন ঢাকায় সেই ঐতিহাসিক (তখনও ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটার খানিকটা ওজন ছিল। ঘটনা ঘটলেই ‘ঐতিহাসিক’ আর সাক্ষাৎকার হলেই ‘বিস্ফোরক’ ছিল না) চুক্তি সই করতে। আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁর সফরসঙ্গী। দিল্লি ব্যুরোয় কর্মরত আমাকে মনোনীত করা হয়েছে সেই সফরে যাওয়ার জন্য।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হলে যে সমস্যাটা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়, সেটা প্রোটোকলের লক্ষ্মণরেখা। ফলে ঢাকার কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া সে বার আর কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু দিন দুয়েকের সংক্ষিপ্ত সফরে দুটো জিনিস মনে হয়েছিল। এক, ঢাকায় কোনও মধ্যবিত্ত নেই। হয় টয়োটা, নয় রিকশা। দুই, ঢাকার রিকশা সে দেশের একটা ‘অভিজ্ঞান’। অসম্ভব রংচঙে আর ঝকমকে। আর রিকশাওয়ালারা প্রকৃত অর্থে দার্শনিক। তাঁরা দেশকালের দিগ্দারির খবর রাখেন। ট্র্যাফিক সিগন্যালে দুটো রিকশা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। লালবাতি জ্বলে-থাকা পর্যন্ত দেশের অবস্থা নিয়ে দুই রিকশাওয়ালা গম্ভীর রাজনৈতিক আলোচনা করছেন। বাতি সবুজ হলে আবার আলোচনা থামিয়ে যে যাঁর গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন সওয়ারি নিয়ে। যাকে বলে ‘সুপারকুল’।
গত এক মাসের কিছু বেশি সময় ধরে ভেসে-আসা বিভিন্ন ভিডিয়োয় দেখছিলাম, সেই রিকশাওয়ালারা সার দিয়ে পড়ুয়াদের মিছিলে শামিল হয়েছেন। ড্রোন শটে উপর থেকে রাজপথে সেই সারিবদ্ধ রিকশার অভিযান দেখা যাচ্ছে। চলেছে তো চলেছেই। চমক লেগেছিল! যেমন চমক লাগল দিন কয়েক আগের একটা ভিডিয়ো দেখে। সম্ভবত ঢাকার শিশু অ্যাকাডেমির সামনের রিকশার ভাস্কর্য উপড়ে ভাঙছে কিছু তরুণ। বাংলাদেশের ‘অভিজ্ঞান’ ভেঙে যাচ্ছে। গুঁড়িয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে।
রাস্তাঘাটে পুলিশ নেই। প্রশাসন নেই। শাসন নেই। চারদিকে উন্মত্ত জনতা। ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবের বিশাল মূর্তির গলায় দড়ি বেঁধে টান মারছে ক্ষিপ্ত মানুষ। কোথাও গা বেয়ে উঠে হাতুড়ির বাড়ি মারছে বিগ্রহের মুখে-চোখে-মাথায়। পরাচ্ছে জুতোর মালা। কোথাও পিছন থেকে বুলডোজ়ার এনে দৈত্যাকার আঁকশি দিয়ে ঘা মারছে মূর্তির ঘাড়ে। উপর্যুপরি ধাক্কায় ঘাড়টা লটরপটর করছে। একটা সময়ে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মাথাটা। ভূলুণ্ঠিত সেই মুন্ডুর উপর ছ্যারছেরিয়ে মূত্রবিসর্জন করতে শুরু করল কিছু চেহারা। মনে হচ্ছিল, এ সব কী দেখছি? এগুলো কি সত্যিই ঘটছে? ঘটছে বাংলাদেশে?
‘নৈরাজ্য’, ‘অরাজকতা’ শব্দগুলো জেনে এসেছি। ইতিউতি লঘু অর্থে প্রয়োগও করেছি। কিন্তু সেটা কখনও এ ভাবে গায়ের উপর এসে পড়েনি। ওই দৃশ্যগুলো কলার ধরে দেখিয়ে দিচ্ছিল, নৈরাজ্য কাকে বলে! অরাজকতা কাকে বলে!
এই বাংলাদেশকে আমি চিনতাম না। চিনি না।
বাংলাদেশে কখনও গিয়েছি মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নিতে। কখনও জ়িনেদিন জ়িদানের সফর কভার করতে। কখনও ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর তাণ্ডবের বর্ণনা লিখতে। সে বারই তিন তলা স্টিমারে করে বিশাল পদ্মা পেরিয়েছিলাম। সেই স্টিমারের নীচের খোঁদলে গোটা দশেক গাড়ি আরামসে ঢুকে যায়। কী বিস্ময়! কী বিস্ময়! আরিচা ঘাট থেকে ঘণ্টাখানেকের কিছু বেশি সময় লেগেছিল ও পারের বিধ্বস্ত বরিশালে পৌঁছতে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে পরিচয় হল। আলাপী মানুষ। স্টিয়ারিং ধরে রেখেই পদ্মায় জাল ফেলিয়ে মাছ ধরে, কুটে, তেল-হলুদ মাখিয়ে, ভাজিয়ে খাইয়ে দিলেন। বিস্ময়, অপার বিস্ময়!
‘আইতে শাল, যাইতে শাল’ বরিশালের নদীনালায় বিপজ্জনক সব নৌকাযাত্রা সামলে-টামলে এবং পর্যাপ্ত ভয় পেয়ে যে দিন ঢাকায় ফিরেছি, ঘটনাচক্রে তার আগের দিনই কলকাতা ছাড়তে হয়েছে তসলিমা নাসরিনকে। পার্ক সার্কাসে সেনা নেমেছে। মনে হল, এখন ময়মনসিংহে তসলিমার পৈতৃক বাড়িতে গেলে তো ‘স্টোরি’। খবরের দুনিয়ার নিয়ম মেনে বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় তখন ভিতরের পাতায় চলে গিয়েছে। কিন্তু রিপোর্টারকে তো ‘পেজ ওয়ান’ নিতে হবে। প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে। অতএব, চালাও পানসি ময়মনসিংহ!
তার পরেও গিয়েছি বহু বার। কখনও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফর কভার করতে (মনে হয়েছিল, বাংলা ভাষার আদর যদি কেউ করতে পারে, তা হলে বাংলাদেশ)। কখনও ‘পহেলা বৈশাখ’-এর অনুষ্ঠান উপলক্ষ করে সরকারি অতিথি হয়ে (তখনও মনে হয়েছিল, বর্ষবরণ এরাই করে। আমরা তুশ্চু)। কখনও কলকাতা প্রেস ক্লাবের প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে।
স্মৃতি রিওয়াইন্ড করে দেখছি, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নির্বাচন কভার করতেও গিয়েছিলাম। যে নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সম্ভবত সে বারই প্রথম গিয়েছিলাম বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডিতে। সেই কবে থেকে ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে মুজিবের হত্যার বর্ণনা গজগজ করেছে মগজে। ধানমন্ডির বাড়ির পিছনে তখনও আলাদা সংগ্রহশালা হয়নি। শুধু মূল বাড়িটাই ছিল। এখন ঘরগুলোর দরজা সলিড কাচ দিয়ে আটকানো। কিন্তু তখন দিব্যি ভিতরে যাওয়া যেত। দেওয়ালে দেওয়ালে বুলেটের ব্রাশ ফায়ারের গর্ত। সেগুলো ছোট ছোট কাচে ঢাকা। গুলির আঘাত সিলিং ফ্যানের ব্লেডে। সেই মান্ধাতার আমলের কালো টেলিফোন। তার পাশে একটা বেঁটে কোকাকোলার বোতল। তাতে অর্ধেক ভর্তি কালচে বাদামী রঙের পানীয়। মনে হয়, দু’একটা চুমুক দেওয়ার পর বোতলটা আর শেষ করা যায়নি।
১৯৭৫ সালের সেই রাতের পর থেকে প্রায় অবিকৃত রেখে দেওয়া হয়েছে ঘরগুলো। দোতলা থেকে এক তলায় নামার একটা সিঁড়ি। ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়ালে দোতলায় সিঁড়ির শুরুতে মেঝের উপর গুলিবিদ্ধ মুজিবের একটা ফ্রেমে বাঁধানো সাদা-কালো ছবি। নিহত মুজিবের চোখ বোজা। চশমা নেই। চুলগুলো ঈষৎ আলুথালু। দুটো হাত মেঝেতে রেখে হাঁটু ভেঙে বসে আছেন। গুলি খেয়ে ওই ভাবেই থপ করে পড়ে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই। পরনে সাদা ফতুয়া আর চেক-কাটা লুঙ্গি। ফতুয়ার বুকের কাছে দু’পাশ বরাবর লম্বালম্বি গোটা চার বা ছয়েক গুলির ফুটো। গর্তগুলো থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
গায়ে কাঁটা দিয়েছিল! তার পরেও অন্তত বার তিনেক বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডিতে গিয়েছি। কিন্তু ছবিটা আর চোখে পড়েনি। সিঁড়িটাও আর ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল! নীচের পোর্টিকোর দেওয়ালে গাঁথা মুজিবের বহুবর্ণ ম্যুরাল ক্ষতবিক্ষত করা হল শাবল দিয়ে!
এই বাংলাদেশকে আমি চিনতাম না। চিনি না।
তবে সম্ভবত সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনাটা ঘটেছিল ২০০৫ সালে সার্ক শীর্ষবৈঠক কভার করতে গিয়ে। এখন ফিরে তাকালে হালকা মজাই লাগে। কিন্তু তখন বেদম ভয় পেয়েছিলাম। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকা তখন, যাকে বলে পুরোপুরি ‘স্যানিটাইজ়ড’। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আসছেন। শীর্ষবৈঠকের আশপাশের বেশ কয়েক কিলোমিটারের বৃত্ত এমন প্রক্ষালন করা হয়েছে, যা তুলনারহিত। উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় মাথায় ‘বন্দুকবাজ’। হুটারের প্যাঁ-পোঁ ছাড়া খুব একটা আওয়াজ নেই। শহরের বড় অংশের লোকজনকে বলে দেওয়া হয়েছে, ক’টা দিন গ্রামের বাড়িতে ঘুরে আসুন। সারা শহরে প্রায় অঘোষিত কার্ফু।
কার্ড ঝুলিয়ে সেই নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ঘুরঘুর করছি আর খবর খুঁজছি। তখনই কোত্থেকে একটা শুনলাম, ঢাকা শহরের প্রায় সমস্ত ভিখারিকে তুলে নিয়ে গিয়ে মিরপুরের একটা ভবঘুরে আবাসে পোরা হয়েছে। সম্মেলন শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সেখানেই আটক রাখা হবে। উর্বর মস্তিষ্কে আইডিয়া কিলবিল করে উঠল। ‘হীরক রাজার দেশে’ মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল ‘ভরসাফুর্তি’ উৎসবের সময় শহরের বাইরের একটা শামিয়ানা-ঘেরা ছাউনিতে ভিখিরিদের পুরে দেওয়ার দৃশ্য। সঙ্গে সংলাপ, ‘নগরীর যা কিছু পূতিগন্ধময়, সব ঢেকে দেওয়া চাই! নইলে কারও রেহাই নাই!’
ছুট-ছুট। মিরপুরে গিয়ে দেখা গেল, খবরটা ঠিকই বটে। ম্যাটাডর বোঝাই করে শহরের যাবতীয় ভিক্ষুককে এনে চার তলা একটা বাড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লোহার গরাদে তালা। তাঁরা সমবেত ক্যাঁচরম্যাচরে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু সে সব আর কে শোনে! খুব নিরীহ ভাবে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে গোটা বিষয়টা নিরীক্ষণ করে এবং কয়েক জনের সঙ্গে আবডালে কথা বলে ফিরে এসে কপি লিখে কলকাতা অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। বলা বাহুল্য, রিপোর্টের হেডিং ছিল হীরক রাজার দেশের সঙ্গে তুলনা করে। পাঁচের পাতার উপরে পাঁচ কলমে সে কপি বেরিয়েও গেল। দিলখুশ।
দু’দিন পরে রাত তিনটে নাগাদ হোটেলের ঘরের ল্যান্ডলাইনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। চোখ-টোখ কচলে হাতড়ে হাতড়ে রিসিভারটা তুলে সাড়া দিলাম।
‘আফনে কী করতাসেন? কী ল্যাখতাসেন?’
কী লিখেছি?
‘ঢাকা শহরে কার্ফু হইসে? হীরক রাজ়ার দ্যাশ? ও সব ল্যাখসেন ক্যান? আফনারে তো ইন্ডিয়ায় ডিপোর্ট কইরা দিব। ন্যাপালের এক সাংবাদিকরে তো অলরেডি ডিপোর্ট কইরা দিসে। শোনেন নাই?’
ঘুম-টুম চুলোয় গেল। ডিপোর্ট? মানে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে দেবে দুটো খবর পছন্দ হয়নি বলে? বলে কী লোকটা? কে-ই বা এ? হোটেলের ঘরের হদিস যোগাড় করে ফোন করছে? তা-ও এমন ভোররাতে? জানলাম, ‘ঢাকায় অঘোষিত কার্ফু’ এবং ‘হীরক রাজার দেশ’-এর অ্যাঙ্গলে লেখা পাঁচের পাতার খবরটা আনন্দবাজার থেকে তুলে তাদের প্রথম পাতায় হুবহু ছেপে দিয়েছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় এবং প্রথম সারির দৈনিক ‘প্রথম আলো’। আমার নাম-টাম সুদ্ধু। ঝপ করে মনে পড়ল, সত্যিই নেপালের এক সাংবাদিক সার্ক কভার করতে ঢাকায় এসে সে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢাকা প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভে বসে পড়েছিলেন। তাঁকে পত্রপাঠ ঘেঁটি ধরে তুলে ফিরতি বিমানে কাঠমান্ডু পাঠানো হয়েছে। আর আমি তো একে ঢাকা শহরকে অঘোষিত কার্ফু-কবলিত লিখেছি। উপরন্তু হীরক রাজার দেশের সঙ্গেও তুলনা করে বসেছি!
বাইরে নভেম্বর মাস। ভিতরে এয়ার কন্ডিশনারের ফিনফিনে বাতাস। তবু কুলকুল করে ঘামছি। কিন্তু মনে হল, এই লোকটাকে সেটা বুঝতে দিলে চলবে না। রোঁয়া ফুলিয়ে দাঁড়াতে হবে। অতএব লম্বা শ্বাস টেনে বুক ঠুকে বললাম, ‘শুনুন! আপনাদের এই দেশে আমার থাকার কোনও ইচ্ছে নেই। ডিপোর্ট করলে উল্টে ভালই হবে। আমি কয়েক দিন আগে বাড়ি ফিরব।’ একটু বিরতি দিয়ে, ‘কিন্তু সার্কের সময় নেপালের জার্নালিস্টকে ডিপোর্ট করা আর ইন্ডিয়ার সাংবাদিককে ডিপোর্ট করা যে এক জিনিস নয়, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন!’
বোধ হয় তাতে কাজ হল। কারণ, গলাটা একটু মিহি হয়ে বলল, ‘আফনে রাগ করেন ক্যান?’
‘রাগ করব না? রাতদুপুরে ফোন করে আলফাল হুমকি দিচ্ছেন! মগের মুলুক নাকি?’
গলাটা বলল, ‘ঠিকাসে। ঠিকাসে। আফনে রাগ করসেন ক্যান সার? দ্যাখবেন একটু।’
ফোন কেটে গেল। কাঁপা-কাঁপা হাতে চোঁ করে ফোন ঘোরালাম কলকাতাস্থিত বার্তা সম্পাদককে। আমাকে যে প্লেনে তুলে সার্কের মাঝপথে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে, সেটা অন্তত যাতে তিনি প্রধান সম্পাদককে জানিয়ে রাখেন। বলা তো যায় না। তেমন কিছু অবশ্য হয়নি শেষ পর্যন্ত। সার্ক কভার করে নির্দিষ্ট দিনেই কলকাতায় ফিরেছিলাম।
তবে ওই এক বারের ‘গুপি শুটিং’ ছাড়া বাংলাদেশ আমায় প্রাণপাত করেই ভালবেসেছে। আমিও বেসেছি। হাজার হোক, বিদেশে গিয়েও নিকষ্যি বাংলায় কথা বলার মতো আরাম তো আর কোথাও নেই। তবে দু’টি অনুযোগও থেকেছে। এক, ঢাকার বীভৎস ট্র্যাফিক জ্যাম এবং দুই, অতিথি হিসেবে ফাঁসির খাওয়া! প্রথমটার তা-ও মেট্রো হয়ে খানিকটা সুরাহা হওয়া উচিত। দ্বিতীয়টা ভয়জনক!
কিন্তু তার আবডালে ঘাপটি মেরে থাকা এই বাংলাদেশকে আমি চিনতাম না। এটা ঠিক যে, গত কয়েক বছর ধরেই শুনছিলাম, হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। শুনতাম, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে হাসিনা শপথ নেওয়ার পরে ১৫ বছর ধরে ভোটের নামে ‘প্রহসন’ হয়েছে বাংলাদেশে। প্রতিটি ভোটেই, বাংলাদেশের বর্ণনায়, ‘ভূমিধস বিজয়’ পেয়েছে হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। বিরোধী বলে কোনও বস্তু নেই। বিএনপি নেতাদের ধরে ধরে জেলে ভরা হয়েছে। সঙ্গে শাসকদলের বিপুল দুর্নীতি। হাসিনাই সম্প্রতি বলেছিলেন, তাঁর পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক! তিনিও হেলিকপ্টার চড়েন! তার সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অত্যাচার। তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। বললেই কোতল। গুমঘরে ঠাঁই। জেদ, দম্ভ এবং স্বৈরাচারের এক বিপজ্জনক ককটেল। তবে একই সঙ্গে এ-ও ঠিক যে, হাসিনার আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সজুত হয়েছিল। তাঁর আমলেই পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো, চট্টগ্রামে সমুদ্রের তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে বিপুল।
তবু এত ক্রোধ, এত ঘৃণা কেন? কেন সারা দেশ জুড়ে এমন জনগর্জন? কেন নির্বিচার হত্যা? কেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিহাস-বিধৃত ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা? কেন জাতির জনক মুজিবের প্রতি এই ভয়াবহ জিঘাংসা? তার চেয়েও বড় কথা, কেন একে ‘গণরোষ’ বলে বৈধতা বা ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা? বাংলাদেশের বন্ধুবান্ধবেরা বলেছেন, ১৫ জুলাইয়ের পর থেকেই ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়েছিল জামাতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির এবং হেফাজতিরা। তারাই দাপিয়ে বেড়িয়েছে অরাজকতার জমিতে। স্বৈরাচার থেকে বেরিয়ে কি বাংলাদেশ তা হলে এখন মৌলবাদের দিকে হাঁটছে? যে ছাত্রীরা জিন্স-টপ পরে আন্দোলন করলেন, সেই আন্দোলনই শেষে তাঁদের জিন্স পরার অধিকার কেড়ে নেবে না তো?
বাংলাদেশ এক গভীর মন্থনের মধ্য দিয়ে চলেছে। সে মন্থনে অমৃত উঠবে না গরল জানে ভবিষ্যৎ। জানে সময়।
নোবেলজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। একটা প্রশাসন তৈরি হয়েছে। থানা খুলেছে। ছাইয়ের গাদা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে একটা দেশ। একটা জাতি। ঘোর কেটে যাওয়ার পরে ছাত্রসমাজের একটা অংশ লুটের জিনিসপত্র ফেরত দিতে যাচ্ছেন। প্রকাশ্যেই অনুতাপ করছেন। অন্যায় কবুল করছেন। তাঁরা রাস্তায় ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁরাই সাফ করছেন ধ্বংসস্তূপ। তাঁরা কি বুঝেছেন যে, তাঁরা যে আন্দোলনে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ এনেছেন, তা জলে যেতে দেওয়া যাবে না? জ্বলেও যেতে দেওয়া যাবে না! তাঁরা যে ‘প্রলয়বিষাণ’ বাজিয়েছিলেন, সেই বিষাণ বাজতে থাকুক। কিন্তু সেই বিষাণের সুরে প্রলয় যেন না ঘটে। মনে পড়ে গেল কাঁচা-পাকা হস্তাক্ষরে বাংলাদেশের দেওয়ালে মওলানা ভাসানির প্রশ্ন— ‘শুনো, ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যায়ো না। পরে ফুলের নাম কী দিবা? ফাতেমা চূড়া?’
আমি এই বাংলাদেশকেই চিনতাম। আমি এই বাংলাদেশকেই চিনতে চাই।
মুসলিমরা রাত জেগে মন্দির পাহারা দিচ্ছেন। দেশের সংখ্যালঘুদের পাশে বুক চিতিয়ে লাঠিসোঁটা হাতে দাঁড়িয়েছেন সংখ্যাগুরুরা। কিন্তু তার সমান্তরালে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় ভিড় বাড়ছে নাচার, অসহায়, শঙ্কিত মানুষের। এখনও।
মন্থন চলছে। তাকিয়ে আছে অমৃত-বুভুক্ষু মানুষ।