হল না। মাত্র একটা পয়েন্টের জন্য। ২৫ মিটার পিস্তলের ইভেন্ট শেষে মনু ভাকের। ছবি: পিটিআই।
পলক এক। পলক দুই। পলক তিন।
প্রায় স্লো মোশনে ভ্রুপল্লব পড়ছিল। বাঁ দিক থেকে সাইড প্রোফাইলে দেখা যাচ্ছে বাঁ চোখ ঢাকা আয়তাকার একটি ঠুলিতে। মাথায় বাঁধা মিনি খুড়োর কল। তাতে আটকানো বিশেষ আই গ্লাসের ভিতর দিয়ে ডান চোখ স্থিরনিবদ্ধ সামনের বুল্স আইয়ে।
দম ধরে বসে আছে সারা দেশ। আনন্দবাজার অনলাইনের ক্রীড়া দফতরের টিভির সামনে উৎসুক এবং পদক-প্রত্যাশী ভিড়। পিস্তল-ধরা ডান হাতটা কোমরের পাশ থেকে ধীর লয়ে সটান উঠল। আঠাকাঠির মতো সামনের চাঁদমারিতে স্থির হল ডান চোখ।
এক পলক পড়ল। দুই পলক পড়ল আবার। তিন, আবার।
‘ফটাস’ করে একটা পেলব শব্দ হল। টিভি স্ক্রিনে ফুটে উঠল বুল্স আইয়ে গুলি বিঁধে যাওয়ার ছবি। দেখতে দেখতে সাক্ষাৎকারে তাঁর কথাটা মনে পড়ছিল, ‘‘যখন আমি পিস্তল হাতে ওই লেনটায় দাঁড়াই, তখন মনে হয়, পরিশ্রম তো করেছি। আমার আর চিন্তা কিসের!’’
উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। ওজন ৬০ কিলো। পিস্তল যেমন ছোড়েন, তেমনই অবসরে বেহালাও বাজান। ঘন ভ্রু। তার তলায় অতলান্ত গভীর চোখ। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। পনিটেলে বাঁধা চুল কপালকে খানিক বিস্তৃত করেছে। দু’কানে দু’টি করে হিরের ছটা। একটি বড়। আর একটি তুলনায় একটু ছোট কুচির মতো। কানে কালোর উপর লাল বুটিদার গুবরে পোকার মতো দেখতে ‘ইয়ার প্রোটেক্টর’। মরাল গ্রীবা। তাতে সোনার সরু চেন থেকে ঝুলছে পুঁচকে পেনডেন্ট। ইন্ডিয়া জার্সির কলারের নীচ থেকে উঁকি মারছে ঘাড়ের ট্যাটু: ‘আই রাইজ়’। ডান হাতে পিস্তল। বাঁ হাতের কব্জিতে হলদে-লাল তাগা। মন্ত্রপূতই হবে বোধহয়। ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স জানা নেই। জানার দরকারও নেই। কিন্তু বাঁ গালে একটি নাতিদীর্ঘ কাটা দাগ এবং তার নীচে আলপিনের ডগার সাইজ়ের একটি কালো তিল এমনিতেই তাঁর আবেদন বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের ডাকনাম ছিল ‘মনু’। সেই নামেই নাম রাখা হয়েছিল ভবিষ্যতের পিস্তলধারিণীর। কিন্তু নামে আর কী এসে-যায়! একে সুন্দরী অ্যাথলিট। তায় অলিম্পিক্স পদকজয়ী। মনু ভাকের জাতীয় ‘হার্টথ্রব’ হয়ে গিয়েছেন।
না কি গিয়েছিলেন? ফেসবুক-টুক খুলে যা দেখছি, তাতে এই সুন্দরী ভারতীয় তরুণীকে ছাপিয়ে আমাদের এই পোড়া দেশ তো বটেই, সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দিয়েছেন তুরস্কের শুটার ইউসুফ দিকেচ। বয়স একান্ন। কাঁচাপাকা চুল। ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির চেহারা। ৮০ কিলোর শরীরের মধ্যপ্রদেশে হালকা, একেবারেই হা-লকা মেদের ছোঁয়া। চোখে আটপৌরে চশমা। পরনে ফ্যাতফ্যাতে টি-শার্ট আর ট্রাউজ়ার্স। এক ঝলক দেখলে কল্যাণ চৌবের স্মার্ট ‘বডি ডাবল’-এর মতো লাগে। বাঁ হাত ট্রাউজ়ার্সের পকেটে। ডান হাতে এয়ার পিস্তল। টকাটক মেরে মিক্সড ইভেন্টে রুপোর পদক জিতে চলে গেলেন। ভাবখানা যেন সকালে বাজার করতে বেরিয়েছিলেন। অলিম্পিক্স শুটিং হচ্ছে দেখে ‘দেখি দাদা, একটু সরুন তো, একটু সামনে যাই’ বলে ঢুকে পড়েছেন। শাকসব্জি-ভরা নাইলনের থলেটা কোথাও একটা হেলান দিয়ে রেখে হেলাফেলায় পিস্তল তুলে লালমোহনবাবুর ভাষায়, ‘ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই!’
‘সোয়্যাগ’ দেখে গোটা দুনিয়া হতবাক। রসিক পশ্চিমবঙ্গীয়রা কেউ বলছেন, ‘‘এত ক্যাজ়ুয়ালি গুলি তো অর্জুন সিংহের ভাটপাড়ার লোক ছাড়া কেউ করতে পারে না। তুরস্ক-টুরস্ক নয়, এ নিশ্চয়ই আসলে ওখানেই থাকে।’’ কেউ বলছেন, ‘‘বব বিশ্বাস ফিরে এসেছে।’’
ইয়ার্কি থাক, পদকজয়ী দিকেচকে নিয়ে গল্পের গরু গাছের মাথা ছাড়িয়ে চাঁদে উঠেছে। সোয়্যাগ-জনিত উৎসাহের আতিশয্যে লোকে এ-ও লিখে দিচ্ছে যে, তাঁর কাছে পিস্তল ছাড়া শুটিংয়ের কোনও সরঞ্জামই ছিল না! ঠিক। কিন্তু পুরো ঠিক নয়। আই গ্লাস এবং আই প্যাচ ছিল না। ঠিকই। কিন্তু হলদে রঙের শব্দনিরোধক লাগানো ছিল দু’কানে।
আর একটা হাত পকেটে ঢুকিয়ে গুলি করা? সে তো সমস্ত পিস্তল শুটারই করেন। মনু ভাকেরও করেন। সরবজ্যোৎ সিংহও করেন। উনিশ শতকের শুরু থেকে এটাই হয়ে এসেছে। কারণ, তাতে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হয়। পিস্তল-ধরা হাতটা চোখের সমান উচ্চতায় রাখতে হয়। অন্য হাতটা পকেটে। নইলে অন্য হাতটা দেহের পাশে লটপট করতে থাকে। তাতে শরীর টলমলে হয়ে যেতে পারে। কিন্তু পকেটে হাত ঢোকালে সেই সম্ভাবনা থাকে না (ঠিক যেমন পুলিশ অফিসারেরা অনেক সময় পিস্তলহীন হাতটা দেহের পিছনে পিছমোড়া করার মতো করে ভাঁজ করে রাখেন। যাতে হাতটা স্থির থাকে। এবং দেহের ভারসাম্য লক্ষ্যভেদের উপযুক্ত)। তাতে ফোকাস ঠিক থাকে। মনঃসংযোগ ঠিক থাকে। এর মধ্যে কোনও ‘ক্যাজ়ুয়াল’ কিছু নেই। অদৃষ্টপূর্ব কিছু নেই। শার্প শুটার বা আততায়ীসুলভ কিছু নেই।
তবে তাতে কি আর সোশ্যাল মিডিয়ার দিগ্গজদের আটকানো যায়? একটা পোস্ট ঘুরঘুর করছে (এবং খেয়ে না-খেয়ে লোকে সেটা শেয়ারও করছে) এই মর্মে যে, দিকেচ ইস্তানবুলের একটি ছোট গ্যারাজে মেকানিকের চাকরি করেন। বিবাহবিচ্ছেদ-জনিত হতাশা কাটাতে নাকি সম্প্রতি শুটিংয়ে মনোনিবেশ করেছেন। অলিম্পিক্সের রুপো জেতার পরে নাকি নৈর্ব্যক্তিক গলায় খোঁজ নিয়েছেন, কাছাকাছি কোনও ‘স্মোকিং জ়োন’ আছে কি না। আর পোডিয়াম থেকে নেমে প্রাক্তন স্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘শ্যারন, তুমি যদি এটা দেখতে পাও, তা হলে শোনো, আই ওয়ান্ট মাই ডগ ব্যাক!’’ তাঁর নাকি শুটিংয়ে কোনও প্রথাগত শিক্ষাই নেই। এবং তিনি নাকি বলেছেন, অলিম্পিক্সে যে আসবেন, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। ভেবেছিলেন বাচ্চাদের নিয়ে একটা নির্ভার উইকএন্ড কাটাবেন।
যদি অতই সোজা হত!
উইকিপিডিয়া অবশ্য এ সব বিল্কি-ছিল্কি এবং রোম্যান্টিক গুলবাজিতে নেই। তারা বলছে, দিকেচ এক জন ‘পেশাদার’ শুটার। তিনি তুরক্সের এক আধাসেনা বাহিনীর প্রাক্তন অফিসার। যারা পুলিশি আওতার বাইরে মূলত গ্রামে-গঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে। এই বাহিনীর শুরু হয়েছিল ১৮৩৯ সালে। এই বাহিনী তুরস্কের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজ়িক্যাল এডুকেশন এবং স্পোর্টসে প্রশিক্ষিত দিকেচ প্রথমে সেই বাহিনীরই পরিচালিত একটি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে বাহিনীতে যোগ দেন ‘কর্পোরাল’ হিসেবে। এক বছর পরে পদোন্নতি পেয়ে ‘সার্জেন্ট’ হন।
‘স্পোর্টস শুটিং’ শুরু করেছিলেন ২০০১ সালে। সেই থেকেই তিনি তুরস্কের জাতীয় দলের সদস্য। এয়ার পিস্তলের বিভিন্ন ইভেন্টে একাধিক বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। জাতীয় পর্যায়ের শুটিংয়ে একাধিক রেকর্ডও আছে দিকেচের। ২০০৬ সালে নরওয়েতে মিলিটারি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ফায়ার পিস্তলে ৫৯৭ পয়েন্ট স্কোর করে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন। উইকিপিডিয়া আরও বলছে, ২০০৭ সালে ভারতের হায়দরাবাদে এমনই একটি সেনা অফিসারদের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন দিকেচ। তবে সেখানে কিছু কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন, এমন কোনও তথ্য নেই।
এ বার আসুন অলিম্পিক্স। ২০০৮ সাল থেকে সামার অলিম্পিক্সে তুরস্কের হয়ে শুটিং ইভেন্টে নামছেন দিকেচ। পদক এই প্রথম। বস্তুত, অলিম্পিক্স শুটিংয়ে তুরস্কেরও এটাই প্রথম পদক। যে পদক পাওয়ার পরে তুরস্কের রেডিয়োকে এক সাক্ষাৎকারে দিকেচ বলেছেন, ‘‘আমার মনে হয়, এক চোখের তুলনায় দু’চোখে দেখে ভাল লক্ষ্য স্থির করা যায়। এটা নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।’’ বস্তুত, এতে পড়াশোনারও দরকার হয় না। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সেনাবাহিনীতে ফৌজিদের দু’চোখ খুলেই গুলি ছুড়তে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অতএব, দিকেচ সেটাই করেছেন, যা তিনি বাহিনীতে চাকরি করার সময় থেকে করে আসছেন। আশ্চর্য নয় যে, তিনি বলেছেন, ‘‘আমার কোনও সরঞ্জামের দরকার হয় না। আই অ্যাম আ ন্যাচারাল শুটার।’’
কথা হল, নিজেকে যিনি ‘ন্যাচারাল শুটার’ বলে আখ্যা দেন, সেই স্বভাব বন্দুকবাজেরও ষোলো বছর লেগে গেল অলিম্পিক্স পদক পেতে! ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল।
২০০৮ সাল। অর্থাৎ, বেজিং অলিম্পিক্স। দূরে কোথাও ঘণ্টাধ্বনি হল যেন। সেই দূরাগত ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে ভেসে এল একহারা চেহারা আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখের এক তরুণের ছবি। অভিনব বিন্দ্রাকে তার আগে চিনতাম না। ক্রীড়া সাংবাদিকদের বৃত্তের বাইরে ভারতের আমজনতাও চিনত না। কিন্তু সেই তিনিই হয়ে গেলেন দেশের ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনাজয়ী (নীরজ চোপড়া আসবেন তারও ১৩ বছর পরে, ২০২১ সালের টোকিয়ো অলিম্পিক্সে)।
অভিনবকে ঘিরে যে উচ্ছ্বাসের প্লাবন বইতে শুরু করেছিল, তা অভিনব বা অপ্রত্যাশিত ছিল না। ১৬ বছর পর প্যারিসে মনুর অলিম্পিক্স সাফল্য কি তাকে ছাপিয়ে যেতে পারল? নাহ্, পারল না। পারত, যদি তিনটি পদক জিতে যেতে পারতেন মনু। সোনা পেলে তো সোনায় সোহাগা! অন্যথায় রুপো বা ব্রোঞ্জ। হল না! মাত্র একটা পয়েন্টের জন্য। হয় না সবসময়।
বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল মনুকে। ভেঙে পড়া ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টায় ঠোঁটের কোনা সামান্য বেঁকে গিয়েছে। মুখে অপ্রতিভ একটা হাসি ঝুলছে। মনে হচ্ছিল, তীরে এসে তরীটাই ডুবে গিয়েছে তাঁর। হাসছেন ঠিকই। কিন্তু কষ্ট করে। আসলে পুরো অলিম্পিক্সটাই তিতকুটে হয়ে গিয়েছে তাঁর। দুটো ব্রোঞ্জ পদক বা একই অলিম্পিক্সে দুটো পদকের গরিমা অতীতের গর্ভে ঢুকে গিয়েছে। এসেছিলেন নতুন কীর্তি রচনা করতে। সেই স্বপ্নসৌধ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে একটু আগে। পিস্তল গোলমাল করায় টোকিয়ো অলিম্পিক্স থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। মাত্র তিন বছরে সেই হতাশা ঠেলে থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অলিম্পিক্সে দু’টি পদক। তাঁকে ঘিরে খিদে বেড়ে গিয়েছিল পদক-বুভুক্ষু ভারতীয় জনতার। মনুর মতোই শনিবার দুপুরটা তাঁদেরও একটু তেতো হয়ে গেল বইকি।
তবে কী জানেন? ইভেন্টের শেষে নেতিবাচক আবেগে রাশ টানতে ব্যস্ত বাইশের তরুণীকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এক দিকে ভালই হল বোধ হয়। শুটিংয়ের দেবতা প্রত্যাবর্তনকারিণীর শিরা-স্নায়ু-ধমনীতে খিদেটা জাগিয়ে রাখলেন। শেষ হয়েও শেষ হল না মনুর অলিম্পিক্স স্বপ্ন। বেঁচে রইল তাঁর গভীর দৃষ্টিতে।
যে চোখ জোড়ায় প্রায় স্লো মোশনে ভ্রুপল্লব পড়ছিল। তখনও। যে চোখ মনে মনে ভবিষ্যতের মনুসংহিতা লিখছিল। তখনও।