(বাঁ দিক থেকে) ধৃত সাগর শর্মা, নীলম আজাদ, অমোল শিন্ডে, মনোরঞ্জন ডি, ললিত ঝা এবং মহেশ কুমাওয়াত। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অসীমদা, অসীম নাথ এখন আর নেই। অকালে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই সে দিন লোকসভার গ্যালারি থেকে নীচে লাফিয়ে-পড়া চেহারাগুলো দেখতে দেখতে অসীমদার কথাও মনে পড়ে গেল। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার কথা। কিন্তু ঝপঝপ করে স্লাইড শোয়ের মতো ভেসে এল দৃশ্যগুলো।
আনন্দবাজার পত্রিকার নয়াদিল্লি ব্যুরোয় বদলি নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে। সংসদের অধিবেশন চলাকালীন মূলত লোকসভা কভার করতে হত। কোনও সহকর্মী না-থাকলে মাঝেমধ্যে রাজ্যসভাও। খেয়ে, না-খেয়ে রোজ সকাল ১০টায় পৌঁছে যেতাম। প্রশ্নোত্তর পর্ব, জ়িরো আওয়ারের পরে সংসদ ভবনে রেলের ক্যান্টিনে পরিচিত সাংসদদের সঙ্গে গল্পগাছা করতে করতে দু’টাকা প্লেট পোঙ্গল খেতাম। কখনও-সখনও একটু বিলাসিতার মাছভাজা। মহামহিম ভারত সরকার ভর্তুকিতে ক্যান্টিন চালান। ভাগ্যিস চালান! আমাদের মতো কিছু বেতনভুক শ্রমিকের দিনের খোরাকি চলে যেত। কিছু সাশ্রয়ও হত।
মাঝেমধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট না-থাকলেও লোকসভার প্রেস গ্যালারিতে গিয়ে বসতাম। যদি অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, জর্জ ফার্নান্ডেজ়, পি চিদম্বরমের মতো কোনও বক্তার বিতর্কে অংশ নেওয়ার কথা থাকত। রিপোর্ট করতাম না। স্রেফ শুনতাম বসে বসে। ঘটনাচক্রে, সুপ্রাচীন সেই লোকসভা কক্ষে আনন্দবাজারের আসন প্রেস গ্যালারির একেবারে প্রথম সারিতে। নীচে ট্রেজ়ারি বেঞ্চ। সরকার পক্ষ এবং মন্ত্রী-সান্ত্রী-সাংসদেরা সেখানে বসেন। প্রধানমন্ত্রীর আসন একদম ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে নীচে। যদি ভুলক্রমে পড়ে যাই, সরাসরি তাঁর মাথায়!
তো সেই সকালেও গিয়েছি। প্রেস গ্যালারি প্রায় সুনসান। শুধু আমি আর অসীমদা ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছি। এ দিক-ও দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা বিভিন্ন সাংসদকে নিয়ে ফালতু প্যাচাল পাড়ছি। পশ্চিমবঙ্গের কোনও সাংসদ প্রশ্নোত্তর পর্বে বা জ়িরো আওয়ারে কিছু বললে নোট নিচ্ছি।
আচমকা বিকট একটা শব্দ হল! তার কয়েক সেকেন্ড পরে আরও একটা! কী হল? কী হল? ভোম্বল হয়ে দেখলাম, উপরের ভিজ়িটর্স গ্যালারি থেকে হুড়ুম করে নীচে লাফিয়ে পড়েছেন দুই যুবক। প্রায় ঘুমন্ত লোকসভায় সেই আওয়াজ বোমার মতো ফেটেছে। ব্যাপক কোলাহল। সাংসদেরা সকলে ত্রস্ত। স্পিকারের আসনে কে ছিলেন, এখন আর মনে নেই। কিন্তু গ্যালারি থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, তিনিও হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। যে ক’জন সাংসদ ছিলেন, দে পিঠটান! দুই যুবক তিড়িং-বিড়িং লাফাচ্ছেন লোকসভা কক্ষের অন্দরে। মার্শালরা তাড়া করছেন তাঁদের। একটা সময়ে দু’জনকেই ধরে ফেলে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হল কে জানে কোথায়!
প্রেস গ্যালারি থেকে লাফ মেরে উঠে দৌড়লাম। অসীমদা অনেক সিনিয়র। বহু দিন দিল্লিতে সাংবাদিকতা করেছে। ঘাঁতঘোঁত জানে। খোঁজ-খোঁজ। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, দু’জনেরই বাড়ি নৈনিতালে। আলাদা উত্তরাখণ্ড রাজ্যের দাবিতে সারা দেশের নজর কাড়তে চেয়ে লোকসভার ভিজ়িটর্স গ্যালারি থেকে নীচে লাফ দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের কী হয়েছিল কে জানে। কিন্তু বেশ মনে আছে, জাতীয় রাজনীতি কভারেজে তখনও কার্যত বালকের মনে কাতর চিন্তা দেখা দিয়েছিল— আহা রে, সুদূর নৈনিতালে বসে ওঁদের বাবা-মা জানতেও পারলেন না, তাঁদের সন্তানেরা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সংসদের নিম্নকক্ষের ওয়েলে প্রায় দোতলা সমান উচ্চতা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে একটা কেলেঙ্কারি বাধিয়েছেন। সেটা অসীমদাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, নিজের প্রতিষ্ঠানের পুজোসংখ্যায় একটা গল্পই লিখে ফেলল। অবশ্যই ‘নাদান’ বালকের নাম-পরিচয় বদলে।
সেটা নব্বইয়ের দশকের প্রায় শেষাশেষি। ২০০০ সালের নভেম্বরে যখন উত্তরপ্রদেশ ভেঙে নতুন উত্তরাখণ্ড রাজ্য তৈরি হল, তখন সেই দুই যুবক কোথায় তা-ই বা কে জানত। বিষয়টা নিয়ে সে দিন তত শোরগোলও হয়নি। যত দূর মনে পড়ে, রেলের ক্যান্টিনে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আবার প্রেস গ্যালারিতে বসে নোট নিতে শুরু করেছিলাম। দৈনিক রিপোর্টে নিছকই একটা ফুটনোট হিসেবে ঘটনাটা থেকে গিয়েছিল।
গত ১৩ ডিসেম্বর যখন সংসদের নতুন ভবনে নবনির্মিত লোকসভার মধ্যে লাফ দিয়ে নামলেন দুই যুবক, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগের ঘটনাটা আবার মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত ভাবে মনে হল, তখন তো এত হল্লা হয়নি। তবে যুক্তিবাদী মন বলল, তখনও তো সংসদে জঙ্গি হামলা হয়নি। উইন্ডস্ক্রিনে পার্লামেন্টের স্টিকার লাগিয়ে সাংবাদিকরা দিব্যি সংসদ চত্বরে গাড়ি পার্ক করতে পারতেন (এই হামলার পর সবচেয়ে সহজ ‘শিকার’ তাঁরাই হয়েছেন। নতুন সংসদ ভবনের প্রধান ফটকের সামনে থেকে সংবাদমাধ্যমকে উচ্ছেদ করা হয়েছে)। আমিও আমার আধভাঙা এবং মাঝেমাঝেই রাস্তায় বন্ধ হয়ে-যাওয়া ফিয়াটটি নিয়ে যেতাম। অনেক সময় সংসদের চত্বরে কর্মরত দিল্লি পুলিশের কনস্টেবলদের দিয়ে গাড়ি ‘ধাক্কা স্টার্ট’ও করিয়েছি। জীবন অনেক সহজ-সরল ছিল। ২০০১ সালে সংসদে সশস্ত্র জঙ্গি হামলা এবং প্রাণহানির পরে সে সব আশা করাও অপরাধ।
যেমন অপরাধ ২২ বছর আগের সেই দিনটা থেকে শিক্ষা না-নেওয়া।
এত দিন মনে হত, নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে দুটো জিনিস প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক দুর্নীতি। দুই, দেশের যেখানে-সেখানে বিস্ফোরণ এবং নাশকতা। কিন্তু এই ঘটনাটার পর মনে হচ্ছে, কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছে। রাজনীতিতে কোথাও তেমন ফাঁক নেই। সেটা ফাটিয়ে হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনে বোধহয় রয়ে গিয়েছে। নইলে এ জিনিস ঘটে না। ঘটতে পারে না।
সংসদের নতুন ভবনের নতুন লোকসভা কক্ষের গ্যালারি থেকে লোকজন লাফিয়ে পড়লেন নীচে। মুখে স্লোগান ‘তানাশাহি নহি চলেগি’ (পরে জেরায় ধৃতেরা জানাবেন, তাঁরা প্রতিবাদ করছিলেন দেশ জুড়ে বেকারত্ব বৃদ্ধি, কৃষকদের ক্রমবর্ধমান সমস্যা এবং মণিপুরের জাতিহিংসার প্রতিবাদে)! অতঃপর তাদের হস্তধৃত পুঁচকে ক্যানেস্তারা থেকে হলদে রং ছড়িয়ে গেল গোটা লোকসভার বাতাসে (খুব দেশদ্রোহ না-হলে বলতে পারি, আতঙ্কটা বাদ দিলে নিছক দৃশ্য হিসেবে দেখতে চমৎকার লাগছিল)। অনেকটা হোলির আবির ওড়ার মতো। কিন্তু এ সব কথা দূর থেকে বলা যায়। গায়ের পাশে হলে আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে বেরোনোর জন্য উতলা হয়। বিশেষত, যখন অনুজ সহকর্মীকে বলা ‘বাহুবলী’ সাংসদ অর্জুন সিংহের সশ্রদ্ধ এবং বিস্মিত বয়ান শুনি, ‘‘পর পর ছ’টা ঘুষি মারলাম। কিস্যু হল না! ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে! ইলাস্টিকের বডি! মাওবাদীদের মতো ট্রেনিং নেওয়া মনে হল।’’
কিন্তু অর্জুনের চেয়েও বেশি বিস্মিত হচ্ছি গোটা ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা দেখে। লোকসভায় এত বড় একটা নিরাপত্তার বেড়া ভেঙে ফেলা হল। কোনও রক্তপাত এবং প্রাণহানি যে হল না, সেটা একেবারেই হামলাকারীদের বদান্যতা। মারণেচ্ছা (ইনটেন্ট টু কিল) নিয়ে লোকসভার গ্যালারি থেকে নীচে লাফ দিলে কারও কিছু বলার ছিল না। যে ক্যানিস্টার থেকে বাসন্তী রঙের আপাত-নিরীহ বাষ্প নির্গত হয়ে একটা পেলব এবং মেদুর দৃশ্যকল্প তৈরি করল, সেটা মারণ গ্যাসও হতে পারত। সে ক্ষেত্রে কী হত, ভাবতে মাথা ঝিমঝিম করে। অথচ সরকারের তেমন কোনও হেলদোল নেই। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে। বরং বিরোধীদের ‘রাজনীতি না-করার’ আর্জি জানাচ্ছে। বেসরকারি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ঘটনার কথা বললেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে কিছু বলছেন না। কোনও বিবৃতি নেই। বিরোধী পক্ষ লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বিক্ষোভ দেখালে তাঁদের অধিবেশন থেকে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) করা হচ্ছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সংসদে হানার ঘটনাটিকে কিঞ্চিৎ লঘু করেই দেখাতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্ভবত ভোটের আগে যাতে গায়ে ব্যর্থতাজনিত কালির পোঁচ না পড়ে। কিন্তু ঘটনা যদি ‘লঘু’ই হবে, তা হলে ধৃতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসদমন আইন ‘ইউএপিএ’ প্রয়োগ করা হল কেন?
মাত্রই কয়েক জন আপাত-নিরস্ত্র মানুষ সংসদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বেআব্রু করে দিলেন। প্রাণভয়ে ভীত সাংসদেরা পড়িমড়ি করে বেঞ্চ ডিঙিয়ে পালাতে লাগলেন। যাঁরা বুঝলেন, বড় বিপদ ঘটছে না, হামলাকারীরা সে অর্থে ‘সশস্ত্র’ নন, তাঁরা ধাওয়া করে আগন্তুকদের ধরলেন এবং ঘা কতক কষিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে তুলে দিলেন। ব্যস, হয়ে গেল? একটা মিষ্টি একাঙ্ক নাটকের মতো? যা শেষ হয়ে গেলে পাগলা দাশু বলল, ‘‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে!’’
না কি ধৃতেরা যে এক জন বিজেপি সাংসদেরই দেওয়া পাস নিয়ে লোকসভার দর্শক গ্যালারিতে ঢুকেছিলেন, সংসদে আলোচনা হলে সেটা রেকর্ডে থেকে যাবে ভেবে প্রথম থেকেই মৌনীবাবাত্বে চলে যাওয়া? নইলে তো আবার মহুয়া মৈত্রকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক’ বলে প্রমাণ করার যে প্রাণপণ চেষ্টা, তার অভিমুখটাই ঘুরে যায়!
এ কি আসলে রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতো নয়, যে ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’? আপাতদৃষ্টিতে তরঙ্গটাকে মিলিয়ে দেওয়ার যত চেষ্টাই করা হোক, কোথাও না কোথাও একটা অসোয়াস্তির বুড়বুড়ি কাটতে থাকবে। কাটতেই থাকবে। কিন্তু তাতে কি মোদী সরকারের কিছু যাবে-আসবে?
অকালপ্রয়াত অসীমদা থাকলে সম্ভবত ‘সিংহ’ অর্জুনের কথাটাই অভিজ্ঞতা থেকে রূপকার্থে বলত— এমন অতর্কিত ঘুষি-টুসিতে মোদী সরকারের কিছু যায়-আসে না। ইলাস্টিকের বডি!