কেউ ভগৎ সিংহের অনুরাগী, তো কারও সমাজমাধ্যমের পাতা জুড়ে শ্রীকৃষ্ণের ছবি এবং গীতার উক্তি। তবে প্রত্যেকের সমাজমাধ্যমেই সামাজিক পরিস্থিতির কথা। কেউ সময়ে সময়ে বেকারত্ব নিয়ে সরব হয়েছেন, তো কেউ আবার সরব হয়েছেন বাতিল হওয়া কৃষি আইন এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে। তাঁরা বুধবার সংসদ হানার মূল অভিযুক্ত।
অভিযুক্তদের মধ্যে নীলম আজা হরিয়ানার হিসারের বাসিন্দা, ললিত ঝার বিহারে বাড়ি হলেও থাকতেন কলকাতায়, অমল শিণ্ডে মহারাষ্ট্রের লাতুর, সাগর শর্মা লখনউ এবং মনোরঞ্জন ডি মাইসুরুরে বসবাস করতেন।
তদন্তকারীরা মনে করছেন, ভগৎ সিংহের সূত্রেই তাঁদের একে অপরের সঙ্গে আলাপ। তদন্তকারীদের বিশ্বাস, ফেসবুকে ‘ভগৎ সিং ফ্যান ক্লাব’ নামে একটি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অভিযুক্তেরা। সেখানেই আলাপ এবং বন্ধুত্ব। অভিযুক্তদের সমাজমাধ্যম ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, নীলম, অমল, ললিত এবং সাগরের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাঁরা প্রায়ই সমাজমাধ্যমে একে অপরকে ছবিতে ট্যাগ করতেন। সেই সব ছবি এবং পোস্ট দেখেও অভিযুক্তদের সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা।
সংসদে ‘রংবাজি’কাণ্ডে অভিযুক্ত একমাত্র মহিলা নীলমের ফেসবুকের পাতায় লেখা, তিনি এক জন সমাজকর্মী। নিজেকে বিআর অম্বেডকরের একনিষ্ঠ অনুরাগী বলেও পরিচয় দেন হরিয়ানার বাসিন্দা। সরকারি চাকরিপ্রার্থী নীলম ‘প্রগতিশীল আজাদ যুব সংগঠন (পিএওয়াইএস)’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে সমাজমাধ্যমে লেখা। এ-ও লেখা যে, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিংহের ভক্ত।
নীলমের বিভিন্ন পোস্টে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে বেকারত্ব এবং বাতিল হওয়া কৃষি আইনের কথা। তাঁর পরিবারের দাবি, নীলম উচ্চশিক্ষিত। তিনি বিএ, এমএ, এমফিল করার পর নেটও পাশ করেছিলেন। কিন্তু বেকার ছিলেন। আর সেই কারণে তিনি হতাশ ছিলেন বলেও পরিবারের দাবি।
অন্য দিকে, সংসদকাণ্ডে যাঁকে মূল পান্ডা বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা, সেই ললিত বিহারের বাসিন্দা হলেও থাকতেন কলকাতায়। সমাজমাধ্যমের পোস্টগুলিতে ললিতকে বার বার বিজেপি সরকারের নীতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে।
বিভিন্ন পোস্টে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ফিদেল কাস্ত্রো এবং চন্দ্রশেখর আজাদ, স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনার প্রচার করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ললিতের সমাজমাধ্যম ঘেঁটে জানা গিয়েছে, তিনি ‘সাম্যবাদী সুভাষ সভা’ নামে এক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। যা ভারতীয় নোটে মহাত্মা গান্ধীর পরিবর্তে নেতাজির ছবি থাকার পক্ষে কথা বলে।
পেশায় শিক্ষক ললিত বিভিন্ন সময়ে সমাজমাধ্যমে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং আমেরিকার নেতৃত্বাধীন নেটো জোটের সমালোচনা করেছেন। তাঁকে উপহাস করতে দেখা গিয়েছে গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরুর অহিংসা নীতি নিয়েও।
তৃতীয় অভিযুক্ত অমল মহারাষ্ট্রের লাতুরের বাসিন্দা। বছর পঁচিশের এই যুবককে বুধবার দেখা গিয়েছিল নীলমের সঙ্গে, সংসদ ভবনের বাইরে। ক্ষেতমজুরের সন্তান স্বপ্ন দেখতেন সেনা এবং পুলিশে চাকরির। কিন্তু বার বার চেষ্টা করেও কোনও পরীক্ষাতেই পাশ করতে পারেননি।
খেলাধুলোর প্রতি উৎসাহী অমলও ভগৎ সিংহের অনুরাগী। টি-শার্ট থেকে মোটরবাইক— সর্বত্র ভগৎ সিংহের ছবি নিয়ে ঘুরতেন তিনি। মাঝেমধ্যেই ভগৎ সিংহের সংগ্রামের কথাও পোস্ট করতেন। অমলের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অনুযায়ী, তিনি শিবভক্ত। ২৫ বছর বয়সি অমল প্রায়ই মহারাষ্ট্রের লাতুর থেকে মুম্বইয়ে যেতেন।
চতুর্থ অভিযুক্ত সাগরের ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে লেখা ‘সাইলেন্ট ভলক্যানো’ অর্থাৎ, ‘সুপ্ত আগ্নেয়গিরি’। ইনস্টাগ্রামে নিজেকে ‘অন্তর্মুখী প্রকৃতি’র এবং ‘আগ্রাসী’ বলেও উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে লেখা যে, তিনি সরল জীবনযাপনে এবং উচ্চ চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী। সমাজমাধ্যমে নিজেকে লেখক, কবি, দার্শনিক, অভিনেতা, চিন্তাবিদ এবং শিল্পী হিসাবেও পরিচয় দিয়েছেন সাগর। মাঝেমধ্যেই মহাভারত থেকে কৃষ্ণের উক্তি নিয়ে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করতেন।
বুধবার সংসদে হানার আগেও সমাজমাধ্যমে একটি ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট করেছিলেন সাগর। ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তিনি হিন্দিতে লেখেন, ‘‘জিতে ইয়া হারে, পর কোশিশ তো জ়রুরি হ্যায়। অব দেখনা ইয়ে হ্যায় সফর কিতনা হাসিন হোগা। উম্মিদ হ্যায় ফির মিলেঙ্গে’’ (জিতি বা হারি, চেষ্টা তো করতেই হবে। এ বার দেখতে হবে যে, এই যাত্রা কতটা সুন্দর হবে। আশা করছি আবার দেখা হবে)।
তবে বুধবারের ঘটনায় পঞ্চম অভিযুক্ত মনোরঞ্জন সমাজমাধ্যমে সক্রিয় নন। মনোরঞ্জনের বাবা জানিয়েছেন, মাইসুরু থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ছেলে পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন। ‘বইয়ের পোকা’ ছিলেন।
অভিযুক্তদের মধ্যে নীলম আজাদ হরিয়ানার হিসারের বাসিন্দা, ললিত ঝার বিহারে বাড়ি হলেও থাকতেন কলকাতায়, অমল শিণ্ডে মহারাষ্ট্রের লাতুর, সাগর শর্মা লখনউ এবং মনোরঞ্জন ডি মাইসুরুরে বসবাস করতেন। তদন্তকারীরা মনে করছেন, ভগৎ সিংহের সূত্রেই তাঁদের একে অপরের সঙ্গে আলাপ।
তদন্তকারীদের বিশ্বাস, ফেসবুকে ‘ভগৎ সিং ফ্যান ক্লাব’ নামে একটি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অভিযুক্তেরা। সেখানেই আলাপ এবং বন্ধুত্ব। অভিযুক্তদের সমাজমাধ্যম ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, নীলম, অমল, ললিত এবং সাগর নিয়মিত যোগাযোগে ছিলেন। তাঁরা প্রায়ই সমাজমাধ্যমে একে অপরকে ছবিতে ট্যাগ করতেন।
পুলিশের তদন্তকারী আধিকারিকদের মতে, প্রায় দেড় বছর আগে অভিযুক্তেরা মনোরঞ্জনের বাড়িতে একটি বৈঠক করেছিলেন। এই বছর মে বা জুন মাসেও তাঁরা একটি দ্বিতীয় বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। এমনকি, সাগর সম্প্রতি ঘন ঘন লখনউ থেকে মহারাষ্ট্র যাতায়াত করতেন বলেও মনে করছেন তদন্তকারীরা।
পাঁচ অভিযুক্তকে পুলিশ ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে। পাঁচ জনকে মদত করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে বিশাল শর্মা নামে এক যুবককেও। তাঁদের ছ’জনকেই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
প্রসঙ্গত, বুধবার দুপুর ১টা নাগাদ বিজেপির মাইসুরু কেন্দ্রের সাংসদ প্রতাপ সিংহের দেওয়া প্রবেশপত্র নিয়ে, জুতোয় রংবোমা লুকিয়ে সংসদ ভবনে ঢুকে পড়েন সাগর শর্মা এবং মনোরঞ্জন ডি নামে দুই যুবক। অধিবেশন চলাকালীন দুপুর ১টার কিছু পরে লোকসভায় জ়িরো আওয়ারের সময় দর্শক আসন থেকে নীচে ঝাঁপ মেরে ছুড়তে থাকেন সেই রংবোমা। ঘন হলুদ ধোঁয়ায় ঢেকে যায় লোকসভার মূল অধিবেশন কক্ষের একাংশ।
পরে সংসদ ভবনের বাইরের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ঢুকে ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’ স্লোগান তোলেন অমল শিন্ডে এবং নীলম। তাঁদের হাতেও ছিল ‘স্মোক ক্র্যাকার’। ললিত রং বোমা নিয়ে তাণ্ডব না চালালেও হোয়াট্সঅ্যাপে সেই ঘটনার ভিডিয়োও প্রথম পাঠিয়েছিলেন। তাঁকে সংসদকাণ্ডের মূল পান্ডা বলে মনে করছে পুলিশ।
—ফাইল ছবি।