Advertisement

Associate Partner

Style Partner

Associate Partner

Weddings Partner

Food Partner

NRI Puja

মনে মনে হারিয়ে যাই, ভুলেই যাই এটা লন্ডনের পুজোমণ্ডপ

আবার টেমসের তীরে বাঙালির বচ্ছরকারের উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে।

লন্ডনের পুজোমণ্ডপ

লন্ডনের পুজোমণ্ডপ

সুচেতনা সরকার
লন্ডন শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১২:০৫
Share: Save:

রানিমা’র শহর লন্ডন এখন দুর্গই বটে। ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে চায় এখন এখানকার মানুষ। ‘ডিল’ না ‘নো ডিল’— এই নিয়ে চুলোচুলি চলছে এখন। মায়ের এ বারে আগমন কিসে যেন! দোলা না হাতি না ঘোড়া কে জানে, তবে মা আসছেন ব্রেক্সিটের টালমাটালে চড়ে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। পাউন্ড-ইউরো টাল খাচ্ছে, পার্লামেন্ট বন্ধ করে গ্রেট ব্রিটেন প্রহর গুনছে কী এক যেন ঝোড়ো হাওয়ার। তবু মা জননীর কি আর হেলদোল আছে? তিনি প্রতিবারের মত হাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও, সিকিউরিটির শ্যেনদৃষ্টিকে কলা দেখিয়ে এসে হাজির। আবার টেমসের তীরে বাঙালির বচ্ছরকারের উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। পুরনো নতুন সব পুজোর কর্মকর্তারা নড়ে চড়ে বসেছেন, বাবু বিবিরা ট্রাঙ্ক ঝেড়ে বের করেছেন গরদ, জারদৌসি কিম্বা ধাক্কা দেওয়া ধুতি।

স্লাও শহর লন্ডনের পশ্চিমে বার্কশায়ার কাউন্টিতে এক টুকরো আঁকা ছবি। বাঙালিরা এক সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছে তাদের পুজোর ক্লাব ‘আড্ডা’। বাঙালির অমোঘ পরিচয় কেমন মাত্র একটা শব্দেই বুঝিয়ে দেওয়া যায়। আড্ডা দিতে দিতেই তো বাঙালি সৃষ্টি করেছে কত কিছু। তেমনই স্লাও-এর বাঙালিরাও প্রথমবার দুর্গাপুজোয় মাতবেন এ বার। এর আগে অনেক দিন থেকে কালীপুজো. সরস্বতী পুজো, ক্রিকেট প্রতিযোগিতা ইত্যাদি আয়োজন করেছে। কিন্তু একেবারে দুর্গাপুজোয় ঝাঁপিয়ে পড়া এই প্রথম। প্রতিমা আসবে শেফিল্ড থেকে। কিন্তু সব থেকে বড় যে চমকটা আসছে এই পুজোয়, তা হল এই প্রথম প্যান্ডেল বাঁধা হবে খোলা মাঠের মধ্যে। পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ সকলে মিলে এই প্যান্ডেল এর ডিজাইন করবে। স্থানীয় শিল্পীরাও হাত লাগিয়েছেন এই প্যান্ডেলে। কর্মকর্তারা ব্যস্ত খাওয়াদাওয়া, নাটক গানবাজনা, স্পন্সর, চ্যানেল, স্টল ইত্যাদি নিয়ে। তরুণ বাঙালিদের উৎসাহ দেখার মতো। নিয়ম মেনে পুজোর নির্ঘণ্ট তো আছেই। নতুন আর একটি পুজোর পালক জুড়ে গেল লন্ডনের টুপিতে। আম জনতার দাবিতে রয়েছে ধুনুচি নাচ। আসছে কলকাতার গানের আর্টিস্ট, শাড়ি গয়নার দোকান। এগরোল, ফুচকা ভেজিটেবল চপ, হালফ্যাশনের ফ্ল্যাটবাড়ির লোন, টিভি চ্যানেলের কোম্পানি— বাদ কেউই নেই। বার্মিংহামের আইটি কর্মী সম্রাট এখানে পুজো করবেন, চক্কোত্তি ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে, ছোটবেলার শেখা মন্ত্র প্রবাসে কাজে আসছে। ভোগ আসছে বাঙালি শেফ-এর রান্নাঘর থেকে— শুক্তো, পাঁচ রকম ভাজা, চাটনি ছাড়া নবমীর পাঁঠার মাংস রসনা তৃপ্তি দেবেই।

আনলিমিটেড আড্ডার আসর ছেড়ে এ বার চলি লন্ডনের দক্ষিণে, সাবেকি সাউথ লন্ডন দুর্গা পুজোর হলে। মিচ্যাম শহরে চাক ৮৯ নামের এক ব্যাঙ্কোয়েট হলে এখন এই পুজো হয়। বিগত ৪০ বছর ধরে হচ্ছে মায়ের আরাধনা। এই পুজো শুরু হয়েছিল যখন, তখন লন্ডনে এত বাঙালি ছিল না। ১৯৭৯-তে আমাদের অনেকেই গুটিগুটি স্কুলে ঢুকেছি বা জন্মাইনি। লন্ডন শহর তখন এত কসমোপলিটন ছিল না। সেই সময় বাঙালি হয়ে থাকা, বাঁচা আরও অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু বুক ভরা বাঙালিয়ানা নিয়ে যে সব মানুষ এসেছিলেন, তাঁদের বিদেশ বিভুঁইতে বছরকার উৎসবে মন হুহু করে উঠত নিশ্চয়। তখন এত মিডিয়া ছিল না, মোবাইল ছিল না, ফেস টাইম, হোয়্যাটস অ্যাপে ফ্রিতে ফোন করা ছিল না, প্লেনের টিকিটের দাম ছিল আকাশ ছোঁয়া। ইচ্ছে থাকলেও যাবার কোন উপায় ছিল না, কিন্তু পরবাসে বসে মন পড়ে থেকেছে বাংলার মাটিতে। এমন ভাবেই শুরু হয়েছিল সাউথ লন্ডন দুর্গাপুজো। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে মূর্তি বদল হয়েছে বেশ কয়েকবার। দক্ষিণ লন্ডনের টুটিং থেকে হল বদল করতেও হয়েছে। ম্যাগি থ্যাচার থেকে হাল আমলের বরিস জনসন পর্যন্ত রাজ্যপাট দেখেছে এই পুজো, নীল খামের এয়ারোগ্রাম থেকে হোয়াটস অ্যাপের মেসেজ অবধি অতলান্তিক যাত্রাপথ পেরিয়ে আসা এই পুজোয় বদলায়নি বীরেন ভদ্রের চণ্ডীপাঠ। ধুতি পাঞ্জাবির বাবুমশাই-এর মাথার রঙ সাদা হয়েছে, কিন্তু এখনও রবি ঠাকুরের কবিতা পাঠের সময় উত্তমকুমারের স্টাইলে তাকাতে ভোলেন না। মনে থাকে পাঁজির পাতার নম্বর, ঠিক কখন সন্ধিপুজো চোখ বুজে বলে দিতে পারেন কর্তাব্যক্তিরা। এখানে এলে মনে হয় বাড়ির পুজোয় এসে পড়লাম বুঝি। মায়ের মুখে প্রাণের টান রয়েছে যে। টানা পাঁচদিন ধরে নিখুঁত ভাবে পুজো দেখতে হলে ডেস্টিনেশন সাউথ লন্ডন দুর্গাপুজো। আসতে হবেই। কদিন ধরে দেদার খাওয়াদাওয়া গান বাজনার মধ্যে একটা ট্র্যাডিশনাল সুর বাজে এখানে। বারোয়ারি পুজো বলে মনেই হয় না ক্রয়ডন, ব্রমলি, সাটন, টুটিং, উইম্বলডন— বলতে গেলে সাউথ লন্ডনের হৃদয়েশ্বরী এখানকার দুর্গা মা। এখানে অঞ্জলি না দিলে মনে হয় যেন কিছুই হল না। ধূপের ধোঁয়ায় ঘন হয়ে আসে অষ্টমীর সন্ধেটা। মাতৃমূর্তি চিন্ময়ী হয়ে ওঠেন। নিয়ম মেনে আসে সন্ধিপুজো, নবমীর হোমে যখন ধোঁয়ার আড়ালে মায়ের মুখ দেখে বুকটা ছলাৎ করে ওঠে, সেই মুহূর্তেই সব ইমোশন জলাঞ্জলি দিয়ে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। এ ভাবে শোরগোল আনন্দের বাতাবরণে

প্রতি বছর দশমী আসে, একে একে সব বউরা বরণ করছে, ভিড়ের মাঝে ছোটঠাকুমাকে দেখতে পাচ্ছি। দুর্গার মুখে সন্দেশ ছুঁইয়ে হাতে পান দিচ্ছে, কানে কানে কী যেন বলছে! চওড়া লাল পাড় গরদ শাড়ি, কপালে টকটকে সিঁদুরের টিপ, ফর্সা গোল হাতে শাঁখা পলা চুড়ি। কে যেন বলছে এসো এসো তোমাকেও সিঁদুর মাখাই! শুনেও শুনতে পাচ্ছি না। ও দিকে মা, কাকিমা, জেঠিমারা সব্বাই খুব হইচই করে সিঁদুর মাখছে। আমি দিদির আঁচল ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছি। হারিয়ে গেছি আমি— সময় হারিয়ে গেছে— ভুলে গেছি এটা লন্ডনের পুজোমণ্ডপ। বাড়ির পুজো তো কত বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্গাদালানটা আজও আছে। সন্ধিপুজোয় আর একশো আট প্রদীপ জ্বলে না, ধূপধুনোর ধোঁয়ায় আর আচ্ছন্ন হয় না আকাশ বাতাস! শুধু টিমটিম করে একটা আলো জ্বলে। পরবাসী সন্তানের কখন ফোন আসবে এই আশায় বসে থাকে আমার বৃদ্ধা জননী। হাজার যোজন দূরের অশক্ত গর্ভধারিণী মায়ের কাঁপা হাতটা মনে মনে শক্ত করে ধরি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy