বাঁ দিক থেকে, পুতিন এবং জ়েলেনস্কি। — ফাইল চিত্র।
ডেভিড বনাম গালিয়াথের লড়াই। দু’বছর আগে পরাক্রমশালী রুশ সেনার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেন যে ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তা দেখে চমকে গিয়েছিলেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। যুদ্ধে প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে পশ্চিমি দুনিয়ার সমর্থনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির বাহিনী যে ভাবে রাশিয়াকে নাস্তানাবুদ করেছিল, তাতে বিশ্বের সামরিক ভারসাম্যের ‘কাঁটা’ নড়ে যেতে পারে বলেও আঁচ করা হচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলির রিপোর্ট বলছে, ইউক্রেনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ড এখন রাশিয়ার দখলে। চলতি মাসে আভদিভকা শহর দখল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সেনার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। নতুন করে মারিয়ুপোলের উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছে তারা। অন্য দিকে, কিভকে দেওয়া আমেরিকা-সহ পশ্চিম বিশ্বের সামরিক সাহায্যে ‘ভাটার টান’ এসেছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের দ্বিতীয় সুবিধাজনক অবস্থানে মস্কো। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে তৃতীয় বর্ষপূর্তির আগেই পুতিনের ইউক্রেন অভিযানের ‘নির্ণায়ক ইতি’ হতে পারে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর ৬টায় রাশিয়ার সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জাতীর উদ্দেশে বক্তৃতায় কিভের বিরুদ্ধে ‘সামরিক অভিযানের’ ঘোষণা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেনের ‘নির্দিষ্ট ৭০টি লক্ষ্যে’ (মস্কোর বিবৃতি অনুযায়ী) ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান হামলা চালিয়েছিল রুশ বাহিনী। পাশাপাশি, স্থল এবং জলপথেও শুরু হয়ে গিয়েছিল আগ্রাসন। ডনবাস-রাশিয়া সীমান্তের পাশাপাশি, বেলারুশে মোতায়েন রুশ ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া ব্রিগেডগুলি হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে ইউক্রেনের মাটিতে।
আক্রমণ শুরু হয়েছিল জলপথেও। ইউক্রেনের উপকূলবর্তী শহর ওডেসা এবং মারিয়ুপোল দখলের লক্ষ্যে ক্রাইমিয়া বন্দর এবং কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন রুশ রণতরী এবং ‘অ্যাম্ফিবিয়ান ল্যান্ডিং ভেহিকল’ থেকে সেনা অবতরণ শুরু হয়ে যায়। রুশ হামলার দ্বিতীয় দিনেই পতনের মুখে দাঁড়িয়েছিল ইউক্রেনের পরিত্যক্ত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চেরনোবিল। ‘সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে পরিচিত ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল রুশ ফৌজ। এমনকি, বেলারুশ সীমান্ত পেরিয়ে আসা রুশ বাহিনীর একাংশ পৌঁছে গিয়েছিল রাজধানী কিভের শহরতলিতে! সীমিত ক্ষমতা নিয়েও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সেনা রুখে দাঁড়িয়েছিল সে সময়। প্রাথমিক একতরফা হানা পরিণত হয়েছিল পুরোদস্তুর যুদ্ধে।
পুতিনের সেই ‘সামরিক অভিযান’ এ বার পা দিল দু’বছরে। আর সেই সঙ্গেই প্রকাশ্যে এল প্রশ্ন— অকিঞ্চিৎকর সামরিক শক্তি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এক বছর ধরে ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে কতটা সাফল্য পেয়েছে ‘মহাশক্তিধর’ রাশিয়া? ২০২২ সালের ৪ জুন, যুদ্ধের ১০০তম দিনে জ়েলেনস্কি জানিয়েছিলেন, তাঁর দেশের ২০ শতাংশ এলাকা রুশ বাহিনীর দখলে। যুদ্ধের ৩৬৫ দিন পার হওয়ার পরেও সামগ্রিক চিত্রটা বিশেষ বদলায়নি।
গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভিযান ঘোষণার এক দিন আগেই পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস (পূর্ব ইউক্রেনের ডনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলকে একত্রে এই নামে ডাকা হয়) এলাকাকে ‘স্বাধীন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন পুতিন। গত দু’বছরে ওই অঞ্চলের কিছু জনপদ রুশ সেনার দখলে এসেছে। অন্য দিকে, দীর্ঘ দু’বছরের অসম যুদ্ধে চমকপ্রদ প্রতিরোধের উদাহরণ তৈরি করা ইউক্রেন সেনা এখন অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জামের অভাবে ভুগতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি করে দেখা দিয়েছে গোলাবারুদের অভাব। প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কির মুখে একাধিক বার সেই অভাবের কথা উঠে এসেছে। তা ছাড়া ঘাটতি রয়েছে জনবলেরও। এই পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে আর কত দিন লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়ায়, রুশ অভিযান শুরুর আগে আমেরিকার সেনার জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি কংগ্রেসের সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যদের জানিয়েছিলেন, পুরোদস্তুর হামলা শুরু করলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেনের রাজধানী কিভ দখল করতে পারে পুতিন-সেনা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং কিভের দোরগোড়ায় পৌঁছেও পিছু হটতে হয়েছে রুশ ফৌজকে। হারাতে হয়েছে, বুচা, ইজ়িয়ুম, বোরোডিয়াঙ্কা, চেরনিহিভ, খেরসনের দখল। আর পিছু হটার আগে নির্বিচারে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। মিলেছে গণকবরের সন্ধান।
তবে গত দু’বছরে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সাফল্য সম্ভবত, পশ্চিমি দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলা করে অর্থনীতিকে সচল রাখা। ইরান, চিন, তুর্কির পাশাপাশি পুরনো বন্ধু ভারতও এ ক্ষেত্রে মস্কোর পাশে দাঁড়িয়েছে। ওয়াশিংটনের ‘হুঁশিয়ারি’ উপেক্ষা করে কেনা হয়েছে রুশ তেল। ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পক্ষে পুতিনের মূল ‘অজুহাত’ ছিল, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটোতে যোগদানের বিষয়ে জ়েলেনস্কি সরকারের তৎপরতা। এ ক্ষেত্রে পুতিনের হুমকিতে কান দেননি জ়েলেনস্কি। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই সেই প্রবণতা সংক্রমিত হয়েছে রাশিয়ার অন্য দুই প্রতিবেশী ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের মধ্যে। রাশিয়ার হুমকি উপেক্ষা করেই নেটোতে যোগদানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা। ইউক্রেন যুদ্ধে জিতলেও যা মস্কোর পক্ষে ভবিষ্যতে উদ্বেগের কারণ হতে পারে।