ইউক্রেনের সমর্থনকারী বাসিন্দারা। ছবি: রয়টার্স
গত সপ্তাহের মঙ্গলবার ভিআইপি রোডের বাড়িতে পৌঁছেছি। ১৭ ঘণ্টা দুবাইয়ে থেমে মোট ২৪ ঘণ্টার যাত্রা ছিল কিভ থেকে। শরীরটাই শুধু কলকাতায়। এখনও মন পড়ে নিপ্রো নদীর দু’পাশের শান্ত শহর কিভে। যখন ছেড়ে এসেছিলাম, তখন ধীরে ধীরে বরফের চাদর সরিয়ে বেরিয়ে আসছে কিভ। বিশ্বাস করতে মন চায় না যে যুদ্ধ আর দখলদারির থাবা নষ্ট করতে পারবে এই শহরটাকে, তছনছ করে দেবে শান্তি!
ডাক্তারি পড়তে ২০১৮ সালে এসেছিলাম। আমি থাকি কলেজ থেকে ন’-দশ কিলোমিটার দূরের একটি অ্যাপার্টমেন্টে। তিন বাঙালি বন্ধু একসঙ্গে। কলেজ পৌঁছতে বাসে পনেরো মিনিট লাগে। গত কয়েক মাসে এখানে বাসভাড়া দু’হৃভনিয়া বেড়েছে। তবে মেট্রোর ভাড়া বাড়েনি। রোজ ফোনে যোগাযোগ রাখছি ওখানকার বন্ধুদের সঙ্গে। যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে রাশিয়া। দূর থেকেই চিন্তা হচ্ছে, বিশেষ করে বন্ধুদের জন্য। খবর পাচ্ছি, চারদিকে হাহাকার শুরু হয়ে গিয়েছে। অথচ ২৪ ঘণ্টা আগেও ছবিটা অন্য রকম ছিল। পশ্চিম ইউক্রেন তুলনায় নিরাপদ বলেই জানি। কিন্তু সেখানকার একটি শহর তের্নোপিলে চাল, গম, তেলের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন এক বন্ধু। সর্বত্র বাজারে জিনিসের দাম আকাশ ছোঁয়া। বোমা পড়ছে চারদিকে। বন্ধুদের দেশে ফেরাও এখন অনিশ্চিত। শুধুই প্রার্থনা করে চলেছি, সব যেন দ্রুত ঠিক হয়ে যায়। আবার আগের মতো মায়াবী রূপকথা হয়ে উঠুক কিভ।
মায়া আছে শহরটায়। শীতে এখানে সূর্যাস্ত হয় বিকেল তিনটে থেকে চারটের মধ্যে। গ্রীষ্মে সূর্যাস্ত হতে হতে রাত আটটা-ন’টা। গ্রীষ্মের মে থেকে অগস্টের রাত খুব সংক্ষিপ্ত। তবুও অদ্ভুত রকম শান্ত এ দেশের বাসিন্দারা। নিচু স্বরে কম কথা বলা এখানকার মানুষ হেঁটে বা সাইকেলে চলাফেরা করতেই সাবলীল। প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়েই ওঁরা এগোতে পছন্দ করেন। প্রতি কিলোমিটার অন্তর এখানে পার্ক দেখা যায়। সে সব খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। বয়স্ক-বাচ্চারা সেখানে দু’দিন আগেও যাচ্ছিলেন। রাস্তার ধারে বসার জায়গায় এঁরা গল্প করছিলেন। তবে সবটাই নিচুতারে বাঁধা। ইউক্রেনের বাসিন্দা বন্ধুদের মধ্যে অনিশ্চয়তার ছায়া দেখেছিলাম। উত্তর-মধ্য ইউক্রেনের এই শহরে সীমান্তের উত্তেজনার আঁচ পড়তে পারে এমনটা ভেবেই ওঁরা বলেছিলেন, সে ক্ষেত্রে পশ্চিম ইউক্রেনের লিভিভের দিকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা।
আমাদের মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ব্যাচেই প্রায় আটশো মতো ভারতীয় আছেন। যাঁদের মধ্যে ২০-৩০ জন বাঙালি। পরিবারের কথায় অনেকেই ফিরে এসেছি। আমি যখন মধ্য প্রাচ্যের উড়ানের টিকিট কেটেছিলাম, তখন এক পিঠের জন্য ২৫০০০ টাকা খরচ পড়েছিল। তার কয়েক দিনের মধ্যেই হুহু করে দাম বাড়তে দেখে এসেছি। এক ঘণ্টার মধ্যে ভাড়া দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ হতে দেখেছি। গত কয়েক মাসে কেজি প্রতি চালের দাম আট হৃভনিয়া অর্থাৎ ২৪ টাকা বেড়েছিল। এখন সব কিছুই লাগামছাড়া হচ্ছে।
সর্বত্র পড়াশোনা চলছিল। ২৪ ঘণ্টা আগেও অনলাইন ক্লাস করেছি। একই সঙ্গে অফলাইন ক্লাসও হচ্ছিল। আজ, বৃহস্পতিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল আমাদের কলেজ। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা উঁকি দিচ্ছে।
লেখক কিভে পাঠরত ডাক্তারি ছাত্র
অনুলিখন: জয়তী রাহা