গুরপতবন্ত সিংহ পন্নুন। —ফাইল চিত্র।
গত কাল কার্ট ক্যাম্পবেল। আজ অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। ক্যাম্পবেল উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা এবং পন্নুন হত্যা-চেষ্টা নিয়ে। ২০২৩ সালের ধর্মীয় স্বাধীনতা রিপোর্ট প্রকাশ করে ব্লিঙ্কেন উদ্বেগ জানালেন ভারতে ক্রমবর্ধমান ঘৃণাভাষণ এবং ধর্মান্তর-বিরোধী আইন নিয়ে। সাউথ ব্লক অবশ্য এতে বিশেষ বিচলিত নয়। বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারতের স্বতন্ত্র অবস্থানই এর কারণ বলে তাদের মত। একই সঙ্গে, পন্নুন-প্রসঙ্গ সহজে পিছু ছাড়বে না বলেও মনে করা হচ্ছে।
সাউথ ব্লকের মতে, মস্কো এবং ওয়াশিংটন উভয়ের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনও প্রথম সারির আঞ্চলিক শক্তি এই ‘নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ’ বা ‘ব্লক রণকৌশলের’ যুগে বিরল। ভারত এই জায়গাটিই নিয়ে চলছে গত কয়েক বছর ধরে। আর সে কারণেই ওয়াশিংটন কখনও ঠান্ডা, কখনও কিছুটা গরম দ্বিপাক্ষিক কৌশল নেয় তাদের ভারত-নীতিতে। গত কাল আমেরিকার উপ বিদেশসচিব ক্যাম্পবেলের কিছুটা গরম স্বরে দেওয়া বিবৃতির পরে ঘরোয়া ভাবে এমনটাই জানাচ্ছে সাউথ ব্লক। ও দিকে এই প্রসঙ্গে মুখ খুলে রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের দাবি, ‘‘ভারত রাশিয়ার অন্যতম পুরনো কৌশলগত অংশীদার। ওয়াশিংটন নিজের চিন-বিরোধী কার্যকলাপে ভারতকে টানার চেষ্টা করছে।’’ সদ্য তৃতীয় ইনিংসের শুরুতে প্রথমেই ইটালি সফরে গিয়ে আমেরিকা-সহ বিশ্বের শক্তিধর জি-৭ গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নরেন্দ্র মোদী নিজেকে কূটনৈতিক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেই শাসনকার্য শুরু করতে চেয়েছিলেন। যার রেশ ধরে আজ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সংসদে তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ‘‘আমার সরকারের প্রয়াসে ভারত বিশ্বকে এক নতুন আস্থা দিয়েছে, বিশ্ববন্ধু হয়ে উঠেছে। গোটা বিশ্ব ভারতকে এখন কী ভাবে দেখে, তা ইটালিতে জি৭ শীর্ষ বৈঠকে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে।’’
ঘটনা হল, এই কূটনৈতিক উচ্চমন্যতাকে কিছুটা হলেও বিব্রত করছে আমেরিকার কর্তার গত কালের প্রচ্ছন্ন হুমকির স্বর। রাষ্ট্রনীতিতে এমনটা বিরল নয় ও এটা ঘটনা যে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে আমেরিকা নিজের স্বার্থেই কাজে লাগাতে চাইছে। কিন্তু ঘরোয়া রাজনীতিতে বারবার ওয়াশিংটনের থেকে চাপের বার্তা পাওয়া, সংখ্যার দিক থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মোদীকে বিড়ম্বনায় ফেলছে এটাও ঠিক।
রাশিয়ার বিষয়টি না হয় বৃহৎ কূটনৈতিক খেলার অঙ্গ। ভারত আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে অশোধিত তেল আমদানি এবং সামরিক যন্ত্রাংশ ও যৌথ উৎপাদনের সমন্বয় চালিয়ে গিয়েছে, তাকে এক রকম মেনেই নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। কারণ কোয়াডের অন্যতম মিত্র হিসেবে, চিন-বিরোধী প্রধান শক্তি হিসেবে, সর্বোপরি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের পতাকা ওড়ানোর অন্যতম বাহন হিসেবে ভারতের গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারে না হোয়াইট হাউস।
তবে ভারতকে যেটা বেশি চাপে ফেলতে চলেছে, তা হল খলিস্তানপন্থী নেতা গুরপতওয়ন্ত সিংহ পন্নুনকে হত্যার চেষ্টা এবং তাতে ভারতের সংযোগের বিষয়টি নিয়ে আমেরিকার চাপ। আমেরিকার ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সমস্ত প্রশ্ন এক দিকে। নিজেদের মাটিতে ভারতীয় গুপ্তচরদের সক্রিয়তার বিষয়টি অন্য দিকে। এ ব্যাপারে ভারত কেন ইউরোপের কোনও দেশের সঙ্গেও সমঝোতা তারা করে না, এ রকম উদাহরণ রয়েছে। ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বহাল রাখার পাশাপাশি, তারা পন্নুনকে হত্যা চেষ্টার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য চাপ বাড়াবে বই কমাবে না, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। এই হত্যার চেষ্টায় যদি সত্যিই ভারতের হাত প্রমাণিত হয়, তা হলে নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের মুখ পুড়বে, এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
ক্যাম্পবেলের বিবৃতির পরেই ব্লিঙ্কেনের বক্তব্যও ভারতের কাছে চাপের কারণ। ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘‘ভারতে আমরা ধর্মান্তর-বিরোধী আইন, ঘৃণাভাষণ, সংখ্যালঘুদের ধর্মস্থান ও বাসগৃহের উপরে হামলার ঘটনা বেড়ে চলতে দেখছি।’’ এটা ‘উদ্বেগের’ বিষয় বলে মন্তব্য তাঁর। ভারতে বিরোধী শিবিরও এই সব বিষয়ে শাসক শিবিরের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলে থাকেন। সংখ্যাগত ভাবে দুর্বল মোদী সরকার দৃশ্যতই ‘বিশ্বগুরু’ থেকে নেমে এসে ‘বিশ্ববন্ধু’ বলে তুলে ধরতে উদ্যোগী। সেই আবহে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার অভিযোগ আগের মতো উপেক্ষা করা সহজ হবে কি না, সেটাই দেখার।