Sir Rodger Penrose

স্নায়ুবিদ্যায় মনোনিবেশ দেখে অভিভূত হয়েছিলাম

পরের বছরই বেরোয় আর একখানি বই। ‘দ্য এমপারার’স নিউ মাইন্ড: কনসার্নিং কম্পিউটারস, মাইন্ডস অ্যান্ড দি লজ অব ফিজিক্স’।

Advertisement

পথিক গুহ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২০ ০৪:৫০
Share:

স্যর রজার পেনরোজ়। ছবি সংগৃহীত।

১৯৮৮ সালকে জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বলা যায়। কারণ ওই বছরে প্রকাশিত হয় স্টিফেন উইলিয়াম হকিংয়ের লেখা বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম: ফ্রম বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাকহোল’। যদিও ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে জেমস ডিউই ওয়াটসনের লেখা ‘দ্য ডাবল হিলিক্স’, ১৯৮৫ সালে রিচার্ড ফিলিপ ফাইনম্যানের লেখা ‘শিয়োরলি ইউ আর জোকিং, মিস্টার ফাইনম্যান’, তবু ওই দু’টি বইকে জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার মাইলস্টোন ধরা হয় না। কেন না, ওই বই দু’টিতে আত্মজীবনী অনেকটাই মেশানো।

Advertisement

সেই অর্থে ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ আদ্যন্ত বিজ্ঞান। যে বই প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে, তা শেষ মুহূর্তে ছিনিয়ে নেয় বান্টাম বুকস। সম্পাদক মশাই হকিংকে উপদেশ দিয়েছিলেন বিজ্ঞানের একটা ফর্মুলা রাখা মানেই নাকি বইয়ের বিক্রি অর্ধেক কমে যাওয়া। হকিং সেই উপদেশ শিরোধার্য করেছিলেন। একটা মাত্র ফর্মুলা (E=mc²) ছাড়া আর কিছুই রাখেননি বইতে। তা সত্ত্বেও বইটি বেশ কঠিন। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও পাঠক পড়ে বোঝেননি। ফলে বইটির তকমা জুটেছে ‘দ্য মোস্ট আনরেড বুক’।

পরের বছরই বেরোয় আর একখানি বই। ‘দ্য এমপারার’স নিউ মাইন্ড: কনসার্নিং কম্পিউটারস, মাইন্ডস অ্যান্ড দি লজ অব ফিজিক্স’। প্রকাশক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। ৪৮০ পৃষ্ঠার সেই বইয়ের লেখক অধুনা স্যর রজার পেনরোজ়। পাতায় পাতায় ফর্মুলা। প্রায় দুরূহ। উপজীব্য কৃত্রিম বুদ্ধি। মেশিন যে কখনও মানুষ হতে পারবে না, সেই কাহিনি।

Advertisement

আরও পড়ুন: আইনস্টাইনের তত্ত্বকে এগিয়ে নিয়েই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল রজার পেনরোজের, সঙ্গে আরও দুই

পেনরোজ়, দেখা গেল, প্রকাশকের উপদেশ শুনছেন না। বরং মানছেন আলবার্ট আইনস্টাইনের পরামর্শ। তা এই যে, বিজ্ঞানের বিষয় বোঝাতে গিয়ে অতিতরল করা চলবে না, তা হলে ভুল করে ফেলার সম্ভাবনা থেকে যায়। পেনরোজ় ভাবছিলেন বন্ধু হকিংয়ের বই যেমন বেস্ট সেলার হয়েছে, তেমন তাঁর বই হবে না। নিজের বই প্রকাশনার কয়েক মাস পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে খোঁজ নেন রয়্যালটি বাবদ কত প্রাপ্য তাঁর। প্রকাশক জানান, রয়্যালটি থেকে একটা বড়সড় মাপের গাড়ি কিনতে পারবেন তিনি। পাঠক জহুরি। সে জানে ফর্মুলার মর্ম। ফর্মুলা-কন্টকিত বইয়ের বিক্রিও প্রচুর।

আরও পড়ুন: করোনায় নিরাপদ নয় ছ’ফুট​

রজার পেনরোজ়কে চেনা যায় ওঁর লেখা বই পড়লে। ‘শ্যাডোজ অব দ্য মাইন্ড: আ সার্চ ফর দি মিসিং সায়েন্স অব কনশাসনেস’ (১৯৯৪), ‘দ্য রোড টু রিয়ালিটি: এ কমপ্লিট গাইড টু লজ অব দ্য ইউনিভার্স’ (২০০৪), সাইকলস অব টাইম: অ্যান একস্ট্রাঅর্ডিনারি নিউ ভিউ অব দি ইউনিভার্স’ (২০১০) অথবা ‘ফ্যাশন, ফেথ, অ্যান্ড ফ্যান্টাসি ইন নিউ ফিজিক্স অব দি ইউনিভার্স’ (২০১৬) বইগুলির পাতায় পাতায় বিজ্ঞানের জটিল ফর্মুলা। ‘দ্য রোড টু রিয়ালিটি’ তো আবার ১০৯৪ পৃষ্ঠার বই। সেই বইও ফর্মুলা-কণ্টকিত। পড়ে এক সমালোচক লিখেছিলেন, ‘‘অ্যান অর্গি অব ফর্মুলাস।’’

আরও পড়ুন: সাংবাদিক সংক্রমিত, ‘কর্মফল’ বললেন আমলা​

আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি যে ব্ল্যাকহোল নামে মহাশূন্যের রাক্ষসের হদিস দেয়, তা স্বয়ং আইনস্টাইনও বিশ্বাস করেননি। সে জন্য আইনস্টাইনকে বলা হয় ‘রিলাকট্যান্ট ফাদার অব ব্ল্যাকহোল’। তাঁরই ফর্মুলা যে ব্ল্যাকহোলের হদিস দিতে পারে, সে কাহিনি দীর্ঘ। অনেক পদার্থবিজ্ঞানী এ কাজে যুক্ত। যাঁরা কেউ মানেননি যে, আইনস্টাইনই ঠিক বলছেন। আমাদের সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর ওই বিজ্ঞানীকূলে অন্যতম। স্যর রজার এমনই এক জন বিজ্ঞানী যে, তিনিও মানেননি আইনস্টাইনের অবিশ্বাস। প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি ব্ল্যাকহোলের হদিস দিচ্ছে।

কত না দিকে স্যর রজারের চিন্তা বিস্তৃত। ১৯৯০-এর দশকে মেতে উঠেছিলেন কনশাসনেস বা চেতনা নিয়ে বিজ্ঞান চিন্তায়। আরিজ়োনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট হ্যামেরফ-এর সঙ্গে প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন যে, স্নায়ুকোষ মাইক্রোটিবিউলের কাঁপুনি না কি চেতনার মূলে। অনেক বার কলকাতায় এসেছেন স্যর রজার। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘শ্যাডোজ অব দ্য মাইন্ড’-এর সূত্রে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ওঁর। অনেক সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তার মধ্যে মনে পড়ছে ওটার কথা। অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম পদার্থবিজ্ঞানী হয়েও স্নায়ুবিদ্যায় ওঁর গভীর মনোনিবেশ দেখে। আসলে বুঝেছিলাম ফিজিক্স দিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বুঝতে চান স্যর রজার।

লেটেস্ট বই ‘ফ্যাশন, ফেথ, অ্যান্ড ফ্যান্টাসি ইন নিউ ফিজিক্স অব দি ইউনিভার্স’ পড়েছি। দেখেছি হালফিলের আইডিয়া স্ট্রিং থিয়োরি নিয়ে তিনি বেজায় চটিতং। অথচ ওই তত্ত্ব নিয়ে এখন বিশ্ব জুড়ে এত মাতামাতি। তিনি যে হুজুগ মানেন না, আপন বিশ্বাসের বলে হুজুগকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তেও প্রস্তুত, তা এই বই পড়লে বোঝা যায়। স্যর রজার বস্তুতই এক অন্য বিজ্ঞানী। আপসহীন!

পুনশ্চ: স্যর রজারের নোবেলপ্রাপ্তিতে মনে পড়ছে আর এক জনের কথা। যাঁর কাজ ওঁর সঙ্গে। হকিং। বেঁচে থাকলে তিনি নোবেলবিজয়ী হতেন কি না, সে প্রশ্ন উঠবেই। হকিংয়ের যা সেরা কাজ, তা হল ব্ল্যাকহোল রেডিয়েশন। ব্ল্যাকহোল থেকে কিছুই বেরোয় না, এটাই জানা আছে সকলের। ১৯৭৪ সালে পণ্ডিতদের চমকে দিয়ে ‘নেচার’ পত্রিকায় মাত্র চার পৃষ্ঠার প্রবন্ধ লিখে হকিং অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ব্ল্যাকহোল থেকে এক ধরনের বিকিরণ বেরোতে পারে। সেটাই হল হকিং বিকিরণ। কিন্তু, মুশকিল হল, বিকিরণ বেরোতে বেরোতে একটা ব্ল্যাকহোলের কর্পূরের মতো উবে যাওয়ায় প্রচুর সময় লাগে। কত? ১-এর পর ৭০টা শূন্য বসালে যত সংখ্যা দাঁড়ায়, তত বছর। অত বছর অপেক্ষার পর জানা যাবে ব্ল্যাকহোল বিকিরণ করে উবে যেতে পারে কি না। অত বছর অপেক্ষা করার সময় তো নেই। সুতরাং হকিং বিকিরণ, অঙ্কে তার প্রমাণ মিললেও বাস্তবে ঘটছে কি না, তা জানা যাবে না। তাই বেঁচে থাকলেও হয়তো হকিং নোবেল পেতেন না। নোবেল দেওয়া হয় তত্ত্বের সত্যতা বাস্তবে প্রমাণ হলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement