ইউক্রেনের মারিয়ুপোলের সেই থিয়েটার হলের বাইরের ফুটপাতে লেখা পেল্লায় অক্ষরগুলো এখনও জ্বলজ্বল করছে উপগ্রহ-চিত্রে। কেউ বা কারা লিখে রেখেছিলেন, ‘বাচ্চারা আছে’। রুশ যুদ্ধবিমানের পাইলটদের দৃষ্টি আকর্ষণই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তব বলছে, বোমা ফেলার আগে কোনও দয়ামায়া দেখাননি রাশিয়ার পাইলটেরা।
বিধ্বস্ত ইউক্রেন। রয়টার্স
বিশাল তিনতলা ইমারতের শুধু খাঁচাটা দাঁড়িয়ে আছে। ছাদ আর বাইরের দেওয়ালেরও অনেকটা উড়ে গিয়েছে রাশিয়ার বোমায়। বাড়ির কঙ্কালের উপরে জমছে ঝুরো বরফ।
ইউক্রেনের মারিয়ুপোলের সেই থিয়েটার হলের বাইরের ফুটপাতে লেখা পেল্লায় অক্ষরগুলো এখনও জ্বলজ্বল করছে উপগ্রহ-চিত্রে। কেউ বা কারা লিখে রেখেছিলেন, ‘বাচ্চারা আছে’। রুশ যুদ্ধবিমানের পাইলটদের দৃষ্টি আকর্ষণই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তব বলছে, বোমা ফেলার আগে কোনও দয়ামায়া দেখাননি রাশিয়ার পাইলটেরা।
মাটির তলায় শক্তপোক্ত বম্ব শেল্টার ছিল ওই থিয়েটারে। বাচ্চাদের নিয়ে হাজারেরও বেশি সাধারণ নারী-পুরুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে খবর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা সবাই বাঁচলেন কি না, উপরে জমে থাকা রাশি রাশি ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে কত জনকে উদ্ধার করা গেল পাতাল থেকে— কিছুই স্পষ্ট নয়।
বস্তুত, এই মানুষগুলোকে নিয়ে এখন নানা রকম পরস্পরবিরোধী কথা শোনা যাচ্ছে। গোটা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার। কিভ থেকে লিভিভ, মারিয়ুপোল থেকে খারকিভ, কোথাওই সাধারণ ছাপোষা জনতাকে বাঁচানোর দায় দেখাচ্ছে না রাশিয়া। সে রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে শুরু করে জি-৭ যতই তাদের সমালোচনা করুক না কেন।
আজ সকালে মূলত রাজধানী কিভ আর লিভিভ লক্ষ্য করে ছুটে আসে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। কিভের উত্তর উপকণ্ঠে একটি বাড়ি ভেঙে পড়ে। এক জন মারা যান। অন্তত ৯৮ জনকে সেই বাড়ি থেকে সরানো হয়। পোল্যান্ড সীমান্ত লাগোয়া লিভিভ শহরের জনসংখ্যা গত সাড়ে তিন সপ্তাহে প্রায় দু’লক্ষ বেড়ে গিয়েছে। লোকে পালাচ্ছে লিভিভ হয়ে। আবার ত্রাণ বা সামরিক সাহায্যও আসছে এই শহর ছুঁয়ে। লিভিভের কেন্দ্রে এখনও পর্যন্ত কোনও হামলা হয়নি। তবে আজ সকাল থেকে লিভিভের আশপাশ ঘেঁষে আছড়ে পড়তে থাকে একের পর এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরেই ছিল যুদ্ধবিমান মেরামতির একটা কারখানা। বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে। শহরের মেয়র জানিয়েছেন, কৃষ্ণসাগর থেকে এ দিন ছ’টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল রাশিয়া। তার মধ্যে দু’টিকে ইউক্রেনের বিমানবাহিনী আটকাতে পেরেছে।
খারকিভে গোলাবর্ষণে একটি বহুতল ভেঙে পড়ে তিন জন মারা গিয়েছেন। গত কাল এই শহরের অদূরে মেরেফা-র একটি স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে রাশিয়ার হামলায় ২১ জন মারা গিয়েছেন। পূর্বের শহর ক্রামাটর্ক্সে মারা গিয়েছেন দু’জন সাধারণ নাগরিক। চেরনিহিভে গত ২৪ ঘণ্টায় মর্গে এসেছে কয়েক ডজন মৃতদেহ। সেখানকার এক হস্টেলে বোমা পড়ে মারা গিয়েছেন বাবা-মা এবং তিন বছরের দুই যমজ-সহ তিন শিশু।
ইউক্রেন সরকার জানাচ্ছে, সে দেশের বসতবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার— কিছুই রেহাই পাচ্ছে না রাশিয়ার আক্রোশ থেকে। আমেরিকান বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত কালই বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত সম্ভাব্য দিকগুলি খতিয়ে দেখছেন সে দেশের কর্তারা। যদি প্রমাণ হয় যে, রাশিয়া ইচ্ছাকৃত ভাবে সাধারণ মানুষের উপরে আঘাত হানছে, সে ক্ষেত্রে তার ফল হবে গুরুতর।
রাষ্ট্রপুঞ্জের রাজনৈতিক প্রধান, আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল রোজ়মেরি ডি’কার্লো সাধারণ মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে তদন্তের দাবি তুলে নিরাপত্তা পরিষদকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক আইনে এ ভাবে আম আদমির উপরে আক্রমণ চালানো নিষিদ্ধ। ‘লজ্জাজনক’ এই যুদ্ধ চালানোর জন্য ভ্লাদিমির পুতিনকে অভিযুক্ত করে জি৭ গোষ্ঠীর বিদেশমন্ত্রীরা যৌথ বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছেন, আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ মেনে অবিলম্বে বাহিনী প্রত্যাহার করুন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ইউক্রেনের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে হামলার ৪৩টি ঘটনা এবং তাতে ১২ জনের মৃত্যুর খবর তারা নিশ্চিত ভাবে জানতে পেরেছে।
পুতিনের যদিও দাবি, তিনি সমাধানসূত্র খুঁজতে প্রস্তুত। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ়ের সঙ্গে তিনি কথাও বলেছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘সমঝোতা থমকে দেওয়ার যাবতীয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিভ। একের
পর এক অবাস্তব প্রস্তাব দিচ্ছে তারা। তবে নীতিগত দিক থেকে রাশিয়া সমাধান খুঁজতে প্রস্তুত।’’ ইউক্রেনের প্লেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির মতে, রাশিয়া বুঝতে পারছে, ২০১৪ সালের ক্রাইমিয়া দখলের মতো এ বার অত সহজে ইউক্রেনের সঙ্গে লড়া যাবে না। তারা জানতই না, প্রতিরোধ ক্ষমতার দিক থেকে কতটা এগিয়ে গিয়েছে ইউক্রেন। শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে তাঁদের কৌশল কী, ভেঙে বলেননি জ়েলেনস্কি। জানিয়েছেন, টিভি, রেডিয়ো বা ফেসবুকের বদলে নিঃশব্দে কাজ করছেন তাঁরা। তবে জ়েলেনস্কির দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, যুদ্ধের পরে কোথায় সীমান্ত টানা হবে, বিচ্ছিন্নতাবাদী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে রাশিয়ার বাহিনী তখনও থাকবে কি না, সে সব নিয়েই গত কালের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
অতিরিক্ত সামরিক সাহায্যের জন্য আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন জ়েলেনস্কি। তবে রাশিয়াকে অন্ধকারে রাখতেই আমেরিকার সাহায্য নিয়ে সবিস্তার বলতে চাননি তিনি।
আজ বাইডেনের সঙ্গে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ফোনালাপ হওয়ার কথা। সূত্রের মতে, আর্থিক বা সামরিক সাহায্য নিয়ে রাশিয়ার পাশে দাঁড়ালে তার ফল যে ভুগতে হবে, জিনপিংকে এ দিন তা বুঝিয়ে দিতে পারেন বাইডেন।
হোয়াইট হাউসের প্রেসসচিব জেন সাকি বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের অবস্থানটা এ দিন বুঝে নেওয়ার সুযোগ পাবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।’’ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিয়নের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীনরেন্দ্র মোদীর আগামী ২১ মার্চ ভার্চুয়াল বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। মরিসন জানিয়েছেন, ইউক্রেনের পরিস্থিতি এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়েও ওই বৈঠকে কথা হবে।