রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত ইউক্রেনের খারকিভ শহরের ফ্রিডম স্কোয়ার। মঙ্গলবারের ওই হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। ছবি: টুইটার।
আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় বার বৈঠকে বসতে চলেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। আগামিকালই সেই বৈঠক হবে বলে সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে একটি রুশ সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে।
বেলারুস সীমান্তে গত কালের বৈঠকে কোনও সমাধানসূত্র বেরোয়নি। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছিলেন, ওই বৈঠকের বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে জানানো হয়েছে। বৈঠকের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু এখনই তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়নি। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পুতিন আলোচনার টেবিলে আসার বার্তা দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সামরিক আগ্রাসন কমানোর কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছেন না। ভ্যাকিউম বোমা, ক্লাস্টার বোমার মতো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার, কথার খেলাপ করে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষকে ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানা বানানোর মতো অভিযোগ ক্রমাগতই উঠছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
আজ ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হানায় অন্তত ১০ জন মারা গিয়েছেন। আহত অন্তত ৩৫ জন। শহরের প্রাণকেন্দ্র ফ্রিডম স্কোয়ারে স্থানীয় প্রশাসনের দফতরগুলি রয়েছে। সেখানেই আজ আছড়ে পড়ে ক্ষেপণাস্ত্র। এলাকার একটি অপেরা হাউসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খারকিভের আবাসিক এলাকাতেও রাশিয়ার হামলায় আরও বেশ কয়েক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। তিন দিক থেকে ইউক্রেনকে ঘিরছে রাশিয়া। একটি আমেরিকান সংস্থার উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে, ইউক্রেনের রাজধানী কিভের দিকে এগোচ্ছে রুশ সেনার প্রায় ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এক কনভয়। সাঁজোয়া গাড়ি থেকে কামান— সবই রয়েছে তাতে। কিভে বোমা ফেলে টেলিভিশন টাওয়ার উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়ার যুদ্ধবিমান। রাজধানী-লাগোয়া নিরীহ গ্রামও বোমার হাত থেকে রেহাই পায়নি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়া যা করছে তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া কিছু নয়।
ইউক্রেন সরকার জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ১৪টি শিশু-সহ অন্তত ৩৫২ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে রাশিয়ার হামলায়। মারা গিয়েছেন সত্তরের বেশি ইউক্রেনীয় সেনাও। তাৎপর্যপূর্ণ হল, রাশিয়াও নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির কথা মেনেছে। কিন্তু যুদ্ধে ঠিক কত জন রুশ সেনা মারা গিয়েছেন, তা স্পষ্ট করেননি পেসকভ। উল্টে ভ্যাকিউম এবং ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার, অসামরিক পরিকাঠামোয় আক্রমণ চালানোর যাবতীয় অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। গত কাল আমেরিকান কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকের পরে সে দেশে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওকসানা মারকারোভা বলেন, ‘‘রাশিয়া আজ ভ্যাকিউম বোমা ফেলেছে। ইউক্রেনে বড় ধরনের ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে তারা।’’
আস্ত একটা মানুষকে মুহূর্তে বাষ্প করে দিতে পারে ভ্যাকিউম বোমা। বিস্ফোরণের সময়ে এই বোমা আশপাশ থেকে সমস্ত অক্সিজেন শুষে নিয়ে বিরাট আগুনের গোলা ছড়িয়ে দেয়। একটি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ঠাসা বহু ছোট বোমার সমষ্টি হল ক্লাস্টার বোমা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর অভিযোগ, ইউক্রেনে এই বোমা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ব্যবহার করছে রাশিয়া। উত্তর-পশ্চিম ইউক্রেনের একটি প্রি-স্কুলে বহু সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাশিয়া সেই বাড়িটিতে ক্লাস্টার বোমা ফেলেছে বলে অ্যামনেস্টির অভিযোগ। হোয়াইট হাউসের প্রেসসচিব জেন সাকি বলেছেন, ‘‘এই সব অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে তা যুদ্ধাপরাধের শামিল।’’
‘‘প্রমাণ করুন, আপনারা আমাদের সঙ্গে আছেন’’— ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে বলেছেন জ়েলেনস্কি। এক দিন আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আবেদনপত্রে সই করেছেন তিনি। আর আজ ভিডিয়ো লিঙ্কের মাধ্যমে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় জ়েলেনস্কি বলেন, ‘‘আমাদের সব শহর অবরুদ্ধ, তবু স্বাধীনতার জন্য লড়ছি। আমরা আমাদের শিশুদের বেঁচে থাকতে দেখতে চাই। আপনাদের পাশে না পেলে ইউক্রেন একা হয়ে পড়বে। ইউক্রেনকে পেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নও শক্তিশালী হবে। আমরা আমাদের শক্তির প্রমাণ দিয়েছি। কিন্তু মূলগত ভাবে আমরা তো আপনাদেরই মতো। আমাদের হাত ছাড়বেন না। প্রমাণ দিন, আপনারা সত্যিই ইউরোপীয়।’’ জ়েলেনস্কির এই বক্তৃতার পরে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যেরা। এ দিকে, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জানিয়েছেন, ইউক্রেনকে আত্মরক্ষার্থে ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনতে ৫ কোটি ডলার সাহায্য দেবেন তাঁরা।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক যদিও বলেছে, এ বার কিভে আরও সুনির্দিষ্ট হামলা চালানো হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর বক্তব্য, ‘‘লক্ষ্যে পৌঁছনো না পর্যন্ত অভিযান চলবে। পশ্চিমি দেশগুলির আগ্রাসন থেকে রাশিয়াকে বাঁচাতে ইউক্রেনের অস্ত্র সমর্পণ এবং সে দেশকে নাৎসিদের কবল থেকে মুক্ত করাটাই আমাদের লক্ষ্য।’’ এমনকি আজ়ভ সাগরের উপকূল এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর সঙ্গেও হাত মিলিয়েছে মস্কো। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মুখপাত্র ইগর কোনাশেঙ্কভ আজ এই কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘‘রুশ রণতরী থেকে চালানো হামলায় ইউক্রেনের দু’টি এয়ারফিল্ড এবং তিনটি রেডার ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তবে কোনও অসামরিক পরিকাঠামোকে নিশানা করা হয়নি।’’ যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাবরের অভিযোগ, বাস্তব চিত্রটি সম্পূর্ণ আলাদা।
কিভ-সহ ইউক্রেনের একাধিক শহরের প্রশাসনের তরফে সাধারণ নাগরিকদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, বাড়ির ছাদে বা দেওয়ালে কোনও বিশেষ চিহ্ন আঁকা দেখতে পেলেই তাঁরা যেন অবিলম্বে সেগুলি মুছে দেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কিছু ছবিতে দেখা গিয়েছে, একাধিক বাড়ির ছাদে আঁকা রয়েছে লাল রঙের ‘ক্রস’ চিহ্ন। একই ধরনের চিহ্ন মিলেছে কিছু বাড়ির দেওয়ালে এমনকি গ্যাসের পাইপলাইনেও। ইউক্রেন প্রশাসনের আশঙ্কা, এ ভাবে আসলে রাশিয়াকে বিমান-হানা চালানোর জন্য লক্ষ্যবস্তু দাগিয়ে দিচ্ছে ‘সন্দেহভাজন চরিত্রেরা’। কাজেই বাসিন্দাদের বলা হয়েছে, তাঁরা যেন বিশেষ করে ছাদের মেঝেতে নজর রাখেন। পশ্চিম ইউক্রেনের রিভনে শহরের মেয়রও নগরবাসীকে সতর্ক করেছেন, তাঁরা যেন কাউকে ছাদে উঠতে না দেন।
দু’দেশের বৈঠকে কী হয়, সময় বলবে। তবে কিভের উপকণ্ঠে ছাপোষা ইউক্রেনীয় যুবক আজ বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে বললেন, ‘‘আসুক না রাশিয়ার সেনা। মলোটভ ককেটেলে স্বাগত জানাব। ফুলও দেব। সেটা হবে ওদের কবরের শেষ ফুল!’’