ছবি রয়টার্স।
দিন কয়েক আগের কথা। নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে দিনের আলোয় বছর পঁয়ষট্টির এক ফিলিপিনো মহিলাকে অশালীন গালিগালাজ ও প্রবল শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হল। আঘাতের তীব্রতায় তিনি মাটিতে পড়ে যান। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গিয়েছে, পড়ে যাওয়ার পরেও আক্রমণকারী তাঁর পেটে লাথি মেরে চলেছে। আর গালি দিতে দিতে একটাই কথা বলে যাচ্ছে সেই শ্বেতাঙ্গ— ‘‘এটা তোদের দেশ নয়। নিজের দেশে ফিরে যা!’’ ভিডিয়ো ফুটেজেই দেখা গিয়েছে, সেখানে তখন অন্তত তিন জন প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক জন আবার সামনের বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী। কিন্তু দুঃখের কথা, কেউই সেই মহিলাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছেন না। বেশ কিছু ক্ষণ এ রকম চলার পরে মহিলার মাথায় লাথি মেরে চলে যায় লোকটি।
গত কয়েক মাসে এমন অসংখ্য এশীয়-নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে দেশ জুড়ে। ষেমন গত মাসেই আটলান্টার স্পা-তে এশীয় মহিলাদের গুলি করে হত্যার ঘটনা। সান ফ্রান্সিসকোয় শারীরিক নিগ্রহের জেরে মারা গিয়েছেন চুরাশি বছর বয়সের এক চিনা বৃদ্ধ। আরও একাধিক মৃত্যুর খবর এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। লস অ্যাঞ্জেলেস, ও সান ফ্রান্সিসকো— দু’শহরেরই চার পাশের এলাকায় এমন একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-র ডিসেম্বর থেকে ২০২১-এর মার্চের মধ্যে এশীয় বশোদ্ভূত মানুষদের উপরে ‘ব্যক্তিগত হামলার’ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আর প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে একটাই বাক্য ছিল আক্রমণকারীদের মুখে— ‘গো ব্যাক টু ইওর কান্ট্রি। নিজেদের দেশে ফিরে যাও।’
ম্যানহাটনের এক বিখ্যাত চিনা রেস্তরাঁর দু’জন কর্মচারীর উপরে আক্রমণের পরে এখন দোকানের মালিক রাত আটটায় রেস্তরাঁ বন্ধ করে দিচ্ছেন। তাঁর মনে হচ্ছে, নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাট বা যানবাহন এশীয় বংশোদ্ভূত—, বা আরও ব্যাখ্যা করে বললে— ‘চিনাদের মতো দেখতে যাঁরা’, তাঁদের জন্য আর নিরাপদ নয়। আর একটি সাম্প্রতিক ঘটনা না উল্লেখ করলেই নয়। সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান আমেরিকান স্টাডিজের এক অধ্যাপকের স্ত্রী বাড়ির সামনে হাঁটছিলেন। এক জন এসে তাঁর মুখে থুতু ছিটিয়ে চিৎকার করে বলে— ‘‘তোমরাই এখানে ভাইরাস নিয়ে এসেছ। তোমাদের ভাইরাস ফেরত দিয়ে দিলাম!’’ লস অ্যাঞ্জেলেস, ওকল্যান্ড, সান ফ্রান্সিসকো অথবা নিউ ইয়র্কের চায়না টাউনে থাকা বহু মানুষ তাঁদের বয়স্ক মা-বাবাদের বাড়ির বাইরে একা পাঠানো বিপজ্জনক মনে করছেন। ‘সেভ আওয়ার এল্ডারস’ বলে একটি আন্দোলনও শুরু করেছেন তাঁরা।
আমেরিকায় প্রথম প্রজন্ম নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় বহু প্রজন্মের চিনা বংশোদ্ভূত মানুষ বাস করেন, যাঁদের দেশের সঙ্গে সম্পর্ক খুব ক্ষীণ। যাঁদের আক্রমণ করা হচ্ছে, তাঁরা বেশির ভাগ মহিলা বা বয়স্ক। অনেকে আদপেই চিনা নন, তাঁদের আদি বাড়ি ফিলিপিন্স, কোরিয়া বা ভিয়েতনামে। সংখ্যালঘুদের প্রতি এই ঘৃণা এ দেশে নতুন নয়। ৯/১১-র পরেও শিখ আর তালিবানের পাগড়ির পার্থক্য করেনি বর্ণবিদ্বেষীরা। একটাই যা আশার কথা। নব্যনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ বিষয়ে যথেষ্ট কড়া অবস্থান নিয়েছেন। সম্প্রতি ‘এশিয়ান কমিউনিটি’র উপরে হিংসার তীব্র প্রতিবাদ করে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন, বর্তমান নেতৃত্ব কোনও ধরনের বর্ণবাদকে বরদাস্ত করবে না।
আমেরিকার সদ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার ‘চিনা ভাইরাস’ বলে যে বিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢেলেছিলেন, তার আঁচ নেভানোর সময়ে এসে গিয়েছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে যুদ্ধ চালানোর পরে এখন নতুন করে লড়াই শুরু করতে হবে বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধেও।