প্রাক্তন: ইমরান খান, ভবিষ্যৎ: শাহবাজ় শরিফ নিজস্ব চিত্র।
মধ্য রাতে সূর্য ডুবল ইমরান খানের রাজত্বে। আস্থাভোটে হার এড়ানো যাবে না বুঝে পার্লামেন্ট ছাড়লেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) এমপিরা। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যশনাল অ্যাসেম্বলিতে উপস্থিত ১৭৪ জনই ভোট দিলেন ইমরানের বিপক্ষে। হেলিকপ্টারে চেপে বাসভবন ছাড়লেন প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। সোমবার নওয়াজ় শরিফের ভাই, পিএমএল(এন) নেতা শাহবাজ় শরিফকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে বিরোধী জোট।
সারা দিন ধরে বহু নাটক, বার বার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন মুলতুবি— মনে হচ্ছিল আজকের দিনটাও কুর্সি আঁকড়ে ধরে থাকছেন ইমরান খান। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির স্পিকার আসাদ কায়সারও বলে দেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে তিনি কিছুতেই অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি করাতে পারবেন না। ফলে রাত ১২টা পর্যন্ত পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করতেই পারেননি বিরোধীরা। এই পরিস্থিতিতে রাত ১২টার সময়ে (ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ১২টা) সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ অধিবেশন ডাকেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উমর আটা বান্দিয়াল। অনাস্থা ভোট করানো ছাড়া আর কোনও পথ নেই বুঝতে পেরে তখন স্পিকার পদ থেকে ইস্তফা দেন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির স্পিকার আসাদ কায়সার। ইস্তফা দেওয়ার সময়ে বলেন, ‘‘ইমরানের সঙ্গে আমার ত্রিশ বছরেরও বেশি সম্পর্ক। আমি কিছুতেই তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।’’ একই সঙ্গে ইস্তফা দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি। প্রসঙ্গত, গত রবিবার ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশের আগে এই ইমরানপন্থী স্পিকার কায়সারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল বিরোধীরা। যার ফলে সে দিন স্পিকারের দায়িত্ব সামলেছিলেন ডেপুটি স্পিকার সুরি। এবং তিনিই ইমরানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন।
কাল ইমরান মুখে ‘আমি সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নিচ্ছি’ বললেও আজ সকালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। তাদের যুক্তি ছিল, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারকে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের কোনও সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেওয়ার এক্তিয়ার নেই আদালতের। পিটিআই এই দাবি করলেও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সেক্রেটারিয়েট কিন্তু আজ দিনভর একাধিক বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছে, ‘‘আজ যদি অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি না করানো হয়, তা হলে তা আদালত অবমাননার শামিল হবে।’’
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় প্রথম বসেছিল ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন। কিন্তু স্পিকার আসাদ কায়সার জানিয়ে দেন, ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোট করাবেন না তিনি। বিরোধী ও সরকার পক্ষের তরজায় দুপুর পর্যন্ত তিন বার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন মুলতুবি করে দেওয়া হয়েছে। রমজান মাস চলছে। ঠিক হয়, ইফতারের পরে, সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ ফের অধিবেশন শুরু হবে। সেই মতো বিরোধী ও সরকার পক্ষের এমপিরা পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে এসে পৌঁছন। কিন্তু ফের দু’পক্ষের তরজায় রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সভা মুলতুবি করে দেন স্পিকার। তার কিছু ক্ষণ পরেই সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে যান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, ইসালামাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি-সহ ৫ বিচারপতি। এর পরেও অনাস্থা ভোট না হলে আদালত অবমাননার দায়ে পড়বেন তাঁরা, তা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ ইস্তফা দেন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। অধিবেশনের দায়িত্ব নেন পার্লামেন্টের প্রাক্তন স্পিকার ও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য আয়াজ় সাদিক।
ততক্ষণে ইসলামাবাদের রাস্তায় নেমে পড়েছে সেনাবাহিনী। হিংসার আশঙ্কায় পার্লামেন্টের সামনে মোতায়েন করা হয় বেশ কিছু বাহিনী। সতর্কতা জারি করা হয় হাসপাতালে, রাস্তায় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় অ্যাম্বুল্যান্সও। বিমানবন্দরেও রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। পাক সংবাদমাধ্যমের খবর, রাতেই আন্তর্জাতিক উড়ান ধরে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেছিলেন বেশ কয়েক জন ইমরান-পন্থী আমলা। তাঁদের আটকে দেওয়া হয়েছে। ইমরান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীরা যাতে দেশ ছেড়ে ‘পালাতে’ না পারেন, তাই তাঁর বিরুদ্ধে ‘এগজ়িট কন্ট্রোল নোটিস’ জারি করার আবেদন জানানো হয়েছে ইসলামাবাদ হাই কোর্টে।
আস্থা ভোটের আগে, আজ রাতে ইমরানের বাড়িতে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়া। দু’জনের কী কথা হয়েছে তা জানা না গেলেও কূটনীতিকেরা মানছেন, সপ্তাহভরের নাটক থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেদের সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল পাক সেনা। যদিও কূটনীতিকেরা এ কথাও মানছেন যে, আমেরিকা-বিরোধী
কথা বলে সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হয়েই এত তাড়াতাড়ি পদ খোয়াতে হল ‘কাপ্তান’-কে।
আজ দিনভর সামাজিক মাধ্যমে ইমরান-নিন্দায় মুখর ছিলেন বিরোধীরা। বেনজ়ির-পুত্র তথা পিপিপি নেতা বিলাবল ভুট্টো জ়ারদারির দাবি, ‘‘স্বচ্ছ নির্বাচনে ভয় পাচ্ছেন ইমরান খান। সেনার মদতে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটাতে চাইছেন।’’ গতকাল দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে ভারতের প্রশংসা করেছিলেন ইমরান। সেই প্রসঙ্গ তুলে নওয়াজ় শরিফ-কন্যা মরিয়ম দাবি করেন, ‘‘ভারতে গিয়ে থাকলেই পারেন প্রধানমন্ত্রী।’’ অনাস্থা ভোটে জিতে শাহবাজ় শরিফ বলেন, ‘‘এক নতুন দিনের সূচনা হল।’’