লুণ্ঠিত শৈশব, বিপন্ন কৈশর: আল শিফা হাসপাতালে জখম শিশু। গাজ়ার বুরেজি ত্রাণ শিবিরে, ধ্বংসস্তূপে প্যালেস্টাইনি কিশোর। ছবি: পিটিআই।
ইজ়রায়েলের কাছে হামলা থামানোর আর্জি জানাল প্যালেস্টাইনি গোষ্ঠী হামাস। এ-ও জানাল, ইজ়রায়েলি বন্দিদের মুক্তি দিতে তারা রাজি, তবে শর্তসাপেক্ষে। শর্ত হল, অবিলম্বে গাজ়ায় সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে ইজ়রায়েলকে। গত দশ দিনের যুদ্ধে গাজ়ায় নিহতের সংখ্যা ৩৭৪৮ ছাড়িয়েছে। জখম ১২,০৬৫ জন। মঙ্গলবার গাজ়ার আল আহলি হাসপাতালে আছড়ে পড়ে ক্ষেপণাস্ত্র। নিহতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়ায় কালই। তার পরে আর হিসেব নেই। এই হামলার পরেই ‘সমঝোতার’ বার্তা দিয়েছে হামাস। ইজ়রায়েল অবশ্য হাসপাতালে হামলার দায় নিতে রাজি নয়। হামাসের আর্জির কোনও উত্তরও দেয়নি তারা।
‘আলোর সন্তানদের সঙ্গে অন্ধকারের সন্তানদের লড়াই। মানবাধিকার বনাম জঙ্গলের আইনের লড়াই’ —গত কাল এমনই এক টুইট করেছিলেন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল গাজ়া। এক অতি-শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে আল আহলি হাসপাতালে। হামলার মুহূর্ত পরেই এক্স-হ্যান্ডলে ছড়িয়েছিল, ‘ব্রেকিং নিউজ়: গাজ়ায় একটি হাসপাতালের ভিতরে হামাসের সন্ত্রাস-ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলি বায়ু সেনা।’ সেই পোস্ট কিছু ক্ষণ পরেই মুছে দেওয়া হয়। একই হ্যান্ডল থেকে পরে লেখা হয়, ‘রহস্যময় বিস্ফোরণ। হামাসের রকেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, না হলে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি পেতে নিজেরাই ঘটিয়েছে।’ সাংবাদিক বৈঠক করে আজ ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক হামাসকেই দায়ী করেছে। প্রায় একই কথা শোনা গিয়েছে ইজ়রায়েল সফররত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মুখে। তিনি বলেছেন, ‘‘এই ঘটনায় আমি আহত। যা দেখছি তাতে বুঝতে পারছি, অন্য পক্ষ এটা করেছে।’’ রাষ্ট্রপুঞ্জে প্যালেস্টাইনের দূত রিয়াদ মনসুর ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, ‘‘ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক জন মিথ্যাবাদী। ওঁর মুখপাত্রই এক্স হ্যান্ডলে জানিয়েছিলেন, ওঁরা ভেবেছিলেন হাসপাতালের কাছে হামাসের ঘাঁটি রয়েছে। সেই ভেবে হামলা চালিয়েছিলেন। পরে উনি সেই পোস্ট মুছে দেন। আমাদের কাছে সেই পোস্টের কপি আছে... এখন ওঁরা গল্প বদলে প্যালেস্টাইনিদের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছে।’’
গাজ়ার হাসপাতালে হামলার নিন্দা করেছে সব রাষ্ট্রই। তবে পশ্চিমি দেশগুলোর কারও মুখে ইজ়রায়েলের নাম নেই। কারও নাম না করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘‘যারা এই ঘটনায় জড়িত, তাদের দায় নিতে হবে।’’ চিনও কারও নাম করেনি। ইজ়রায়েলের দাবি প্রসঙ্গে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, হামাসের কাছে কি সত্যিই এত শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে, যা এক নিমেষে গুঁড়িয়ে দিতে পারে একটা গোটা হাসপাতাল? যুদ্ধের প্রথম দিন যখন তারা অতর্কিতে হামলা চালিয়েছিল ইজ়রায়েলে, তখনও তো এত শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়েনি তারা! সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনও শোনা যাচ্ছে, হামলার আগে ওই হাসপাতালে হুমকি ফোন এসেছিল। সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে ইজ়রায়েল। এ দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী আজ সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেছে, তাদের কাছে থাকা ক্ষেপণাস্ত্র আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। গাজ়ায় সেই যুদ্ধাস্ত্র ছোড়া হলে আরও বড় ক্ষতি হত।
গাজ়ার ওই হাসপাতালের তরফেও একটি সাংবাদিক বৈঠক করা হয়েছে। সেই দৃশ্য ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। চারপাশে মৃতদেহের স্তূপ। তার মাঝে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ফাদেল নইম জানিয়েছেন, হাসপাতালে অসংখ্য ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে রয়েছে। বহু মানুষ জখম। নইম বলেন, ‘‘হাসপাতালে অনেক মানুষ মারা গিয়েছেন। অনেকে জখম। লোকজন ছুটতে ছুটতে আসছিল। তাঁদের মুখে আর্তনাদ, ‘বাঁচাও, সাহায্য কর।’ যত জনকে পেরেছি বাঁচিয়েছি আমরা। কিন্তু এই ক’জন তো ডাক্তার! আহতের সংখ্যা সেই তুলনায় অনেক বেশি। বিস্ফোরণের পরে যাঁরা বেঁচেছিলেন, তাঁদের অনেককেই সাহায্য করতে পারিনি, চোখের সামনে মারা যেতে দেখেছি।’’ একটি ব্রিটিশ দৈনিকের সাংবাদিক রুশদি আবুআলউফ জানান, আজও বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে প্রিয়জনের দেহাংশ খুঁজে চলেছেন!
গাজ়ার এই পরিস্থিতির জন্য আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়াকে কাঠগড়ায় তুলেছে হামাস কর্তা ওসামা হামদান। তিনি জানান, যারা ইজ়রায়েলকে সমর্থন করছে, তাদের সকলকে এই হামলার দায় নিতে হবে। মিশর প্রথম আরব দেশ, যারা ইজ়রায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছিল। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, বাহরাইন ও মরক্কো ইজ়রায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে শুরু করেছিল। সৌদি আরব নিজেই চাইছিল ইজ়রায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ করতে। কিন্তু এখন তারা সকলেই একযোগে ইজ়রায়েলের নিন্দা করছে। আজ ইজ়রায়েলের মিত্র দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেছেন জর্ডনের রাজা আবদুল্লা, মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাতা এল-সিসি এবং প্যালেস্টাইনি প্রেসিডেন্ট মেহমুদ আব্বাস। উল্টো দিকে, বাইডেনকে ‘সত্যিকারের বন্ধু’ বলে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নেতানিয়াহু। তাঁকে পাশে বসিয়ে আইএস-এর সঙ্গে হামাসের তুলনা করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘হামাসকে হারাতে সভ্য জগতের উচিত একজোট হওয়া। ওদের আমরা নিশ্চিহ্ন করবই।’’