San Francisco

মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা সময়ে বাস করছি 

চার দিকে ব্যাপক আতঙ্ক। কিছু ক্ষণ পরপরই নিয়ম আরও কড়া হওয়ার খবর আসছে।

Advertisement

গায়ত্রী পাল

সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়া শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০৪:১৬
Share:

জনশূন্য সান ফ্রান্সিসকো।—ছবি রয়টার্স

এক অনলাইন শপিং সাইট থেকে এক ব্যাগ আনাজ কিনলাম। জানি না কবে ডেলিভারি পাব। বুঝতে পারছি করোনা-আতঙ্কের জেরে যা পরিস্থিতি, তাতে অনলাইন শপিং সাইটের উপর চাপ বাড়ছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে কয়েক সপ্তাহ আগেই কয়েক বার মুদিখানায় গিয়ে বেশ কিছু কাঁচা আনাজ আর মাছ-মাংস কিনে রেখেছিলাম। আগামী কয়েক দিন সেগুলিই ভরসা।

Advertisement

চার দিকে ব্যাপক আতঙ্ক। কিছু ক্ষণ পরপরই নিয়ম আরও কড়া হওয়ার খবর আসছে। এত দিন ‘সামাজিক দূরত্ব’-র নিয়ম মেনেই এমন সময়ে মুদিখানায় গিয়েছিলাম, যখন সেখানে ভিড় কম থাকে। তবে শুক্রবারের পর থেকে এখানে জরুরি অবস্থা জারি করেছে মার্কিন প্রশাসন। করোনা-সংক্রমণের অন্যতম উৎসস্থল সান্টা ক্লারা কাউন্টি বে অঞ্চল। এই এলাকাতেই আমাদের বাস। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রতি রাতে ঘুমোনোর আগে এক বার করে দেখে নিই, সান্টা ক্লারায় নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কতটা বাড়ল। ঘুম থেকে উঠেও প্রথম কাজ ওই একই, আক্রান্তের সংখ্যাটা জেনে নেওয়া।

এখন বাইরে থেকে আসা কারওর মাধ্যমে সংক্রমণের ঘটনা সংখ্যায় কমলেও দ্রুত তা কমিউনিটির মধ্যেই ছড়াচ্ছে। প্রতিদিনই তা বেড়ে চলেছে। গড়ে রোজ ১০ থেকে ১৫টি নতুন ঘটনা সামনে আসছে। গ্রাফ ক্রমশ উপরের দিকেই উঠছে। ফলে অনেক দেরিতে হলেও এই জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন।

Advertisement

গত সপ্তাহের গোড়াতেই একে একে এখানকার স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সরাসরি ক্লাস নেওয়ার বদলে অনলাইন ক্লাস করানোর কথা ঘোষণা করেছিল। প্রায় রাতারাতিই শিক্ষকদের অনলাইনে পড়ানোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে দিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও। অন্তত আগামী তিন সপ্তাহ এই পদ্ধতিতেই পড়াশোনা চালাতে হবে এখানকার ছাত্রছাত্রীদের।

বিভিন্ন প্রযুক্তি সংস্থার কর্মীদের এই ক’দিন বাধ্যতামূলক ভাবে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা বাড়িতে বসে কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে জমায়েত, বৈঠক বা কোনও রকম অনুষ্ঠানের উপরে। সম্প্রতি ক্যালিফর্নিয়ার গভর্নর সমস্ত পানশালা বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছেন। রেস্তরাঁয় আসনের সংখ্যা ৫০% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত সিনেমা হল, নাইটক্লাব আপাতত তালাবন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়রও। এক নিমেষের মধ্যে যেন সব কেমন ওলট-পালট। মনে হচ্ছে আমরা যেন সম্পূর্ণ আলাদা সময়ে বাস করছি!

মনে পড়ছে, গত শীতের শুরুতে মাইক্রোবায়োলজির ল্যাব ক্লাসে ‘ভাল করে হাত ধোয়ার’ পদ্ধতি নিয়ে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। যার মধ্যে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে ঘষে ঘষে হাত ধোয়ার বিষয়টিরও উল্লেখ ছিল। কে জানত, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তা হঠাৎ এতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। ইটালির মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি যাতে আমাদের বা অন্য কোথাও না হয়, তার একমাত্র উপায় হল সংক্রমণের গ্রাফটিকে নিম্নগামী করা। যার সব চেয়ে কার্যকরী উপায় ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা বেশির ভাগ সময়ে বাড়িতেই কাটানো। সংক্রমণ যাচাই করতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার সরঞ্জামেরও (টেস্ট কিট) এখন আকাল। এখানে সংশ্লিষ্ট সরকারি এবং বেসরকারি সংগঠনগুলি চেষ্টা করে চলেছে যাতে পর্যাপ্ত টেস্ট কিটের ব্যবস্থা রাখা যায়।

মাস খানেক আগে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাইরোলজিস্ট বন্ধু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এমন একটি পরিস্থিতি আসতে চলেছে। যে গাণিতিক মডেলের উপরে ভিত্তি করে তিনি সেই দাবি করেছিলেন, তা প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য ল্যানসেট’ পত্রিকায়। এমন একটি মহামারি আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা বলে জানিয়েছিল সেন্টার অব ডিজ়িজ় কন্ট্রোলও। তাই কিছুটা হলেও মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম। পূর্বাভাস মেনেই সময়ের হাত ধরে হাজির সেই মহামারি।

অনেককে দেখছি, অজানা আতঙ্কে ভুগছেন। সেই থেকেই বেশি করে ‘প্যানিক বাই’ বা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জিনিস বাড়িতে মজুত রাখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার এবং টয়লেট পেপার কিনে জমিয়ে রাখছেন তাঁরা। এই বিষয়টি তাঁর বই ‘দ্য সাইকোলজি অব প্যানডেমিক্‌স’-এ বিশ্লেষণ করেছেন ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট স্টিভেন টেলর। যদিও দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য মহামারির চেয়ে করোনা-সংক্রমণে মানুষের আতঙ্ক বহুগুণ বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ায় করোনা সংক্রান্ত যে পরিমাণ ভুয়ো খবর ছড়িয়েছে, তা-ও এর জন্য দায়ী। বিশেষজ্ঞেরা বারবার অনুরোধ করছেন, অযথা ভুয়ো খবর ছড়াবেন না। অযথা আতঙ্কে ভুগবেন না। এবং অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে চলবেন।

‘সামাজিক দূরত্ব’-র সময়ে কী কী করে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়, তার তালিকাও প্রচার করা হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। এই তালিকার সবচেয়ে উপরে রয়েছে রান্না করা এবং পছন্দের শো দেখার মতো বিষয়গুলি।

খাওয়া দিয়ে শুরু করেছিলাম তাই খাওয়া দিয়েই শেষ করি, হাজার হোক বাঙালি তো! আর কিছু না পেলে ঘরে যথেষ্ট চাল, ডাল মজুত আছে। চটজলদি খিচুড়ি খেয়েই চলে যাবে। তবে যে স্বাস্থ্যকর্মীরা বিরামহীন পরিশ্রম করে চলেছেন, তাঁদের জন্য অভিবাদন। এ বড় কঠিন সময়। তবে আমরা তা কাটিয়ে উঠবই। সকলে সাবধানে থাকুন। সুস্থ থাকুন।

(লেখিকা ক্যালিফর্নিয়া কলেজের শিক্ষিকা)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement