এ যেন প্রকৃতির জারি করা কার্ফু। মানতে বাধ্য বিশ্ববাসী। করোনাভাইরাসের দাপটে ঘরবন্দি হতে বাধ্য হয়েছেন বিশ্ববাসী। অর্থনীতির মতো স্তব্ধ বিভিন্ন দেশের জনজীবনও। আক্ষরিক অর্থেই জনশূন্য বিভিন্ন দেশের রাজপথ। এখনও অবধি করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে দু’লক্ষ। মৃত প্রায় ন’হাজার মানুষ। সুস্থ হয়েছেন প্রায় ৮৬ হাজার আক্রান্ত। দিনের ব্যস্ত সময়ে আতঙ্কের শীতল নিস্তব্ধতার সাক্ষী বেজিং-এর রাজপথ।
২৭০০ বছরের বেশি প্রাচীন ঐতিহাসিক রোম শহরের সব পথ এখন পাণ্ডববর্জিত। চিনের পরে ইতালিই সবথেকে বেশি মাশুল দিয়েছে করোনাভাইরাসের। অতীতের নবজাগরণের উন্মেষ হওয়া দেশ এখন আতঙ্কের প্রহর গুনছে। সবথেকে বেশি আক্রান্ত দেশের উত্তর অংশ। সব মিলিয়ে ইতালির বিভিন্ন প্রান্তে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩০০০। আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫ হাজার ৭১৩ জন। করোনা থেকে মুক্তির খোঁজে গৃহবন্দি ইটালিবাসী। প্রাণের স্পন্দন হারিয়েছে তার সুদৃশ রাজপথ।
ইটালির মত ভয়াবহ না হলেও করোনা-কাঁটায় সঙ্গীন অবস্থা তার দুই প্রতিবেশী দেশ, ফ্রান্স ও স্পেনের। কাজের দিনের ব্যস্ততা বা সপ্তাহান্তের ছুটির মজা, কোনও দৃশ্যই আর দেখা যাচ্ছে না প্যারিসের রাজপথে। ইউরোপের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ফ্রান্সে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে। সে দেশে এখনও পর্যন্ত ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত ৯১৩৪ জন। এর মধ্যে অবশ্য চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১২ জন। সংক্রমণ রুখতে আগে থেকেই স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, শপিং মল, রেস্তোরাঁ-পানশালা সব বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ আপাতত ৩০ দিন নাগরিকদের ‘ঘরবন্দি’ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
১৮ মার্চের বিকেল ৪টে পর্যন্ত স্পেনে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ৯১০। মৃত্যু হয়েছে ৬২৩ জনের, সম্পূর্ণ সেরে উঠেছেন ১০৮১ জন। পুরো দেশকেই ‘লকডাউন’ বা গৃহবন্দি করা হয়েছে। সমস্ত উড়ান পরিষেবা বন্ধ। ওষুধের দোকান, মুদিখানা বা সুপারমার্কেট ছাড়া আর কিছু খোলা নেই এবং মানুষের শুধু এই জায়গাগুলো ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়াও নিষিদ্ধ। আইন ভাঙলে জরিমানাও করা হচ্ছে। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের জনহীন রাজপথ এখন স্বাভাবিক জীবনছন্দ দেখার অপেক্ষায়।
লন্ডন তথা ব্রিটেনের করোনা-পরিস্থিতি ইটালি বা ইরানের মতো ভয়াবহ না হলেও ইতিমধ্যেই নড়েচড়ে বসেছে সে দেশের সরকার। সোমবার থেকেই করোনা মোকাবিলায় আরও কড়া পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে বরিস জনসন সরকার। দেশ জুড়ে কড়া নির্দেশিকা জারি হয়েছে। শুধুমাত্র করোনা আক্রান্তদের সামাজিক মেলামেশা থেকে বিরত রাখাই নয়, গুরুতর অসুস্থ সত্তরোর্ধ্বদের আইসোলেশনে রাখার পরামর্শও দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার।সেই পরিস্থিতির সাক্ষ্য দিচ্ছে জনশূন্য লন্ডন-রাজপথ।
করোনা-আতঙ্কে সুর আর ছন্দ হারিয়েছে সাউন্ড অব মিউজিকের দেশ। রাজধানী ভিয়েনার পথ এখন জনহীন। করোনার হানা থেকে রক্ষা পেতে বাড়িকেই নিরাপদ মনে করছেন অস্ট্রিয়াবাসী। সংবাদসংস্থার মতে, করোনায় ইউরোপে মৃতের সংখ্যা এশিয়াকেও টপকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কিছু দিন আগে একটি গবেষণাপত্রে লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের অধ্যাপক নিল ফার্গুসন দাবি করেছেন, আমেরিকায় করোনার বলি হতে পারেন অন্তত ২২ লক্ষ মানুষ। এখানকার ৫০টি প্রদেশে করোনা-আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম দিকে ভাইরাস-হানায় তেমন গুরুত্ব না দিলেও হোয়াইট হাউস থেকে আজ বলেছেন, ‘‘দেশে এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি। আমাদের এই লড়াইটা জিততেই হবে।’’ সে জন্য আইন জারি করে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসা সামগ্রী (মাস্ক, গ্লাভস) তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তালাবন্দি জনজীবনে জনশূন্য মার্কিন-রাজধানীর পথ।
অন্যসময় যে রাজপথে গাড়ির স্রোত থাকে, লস অ্যাঞ্জেলসের সেই সরণিতে এখন হাতে গোনা গাড়ি চলছে। সদাব্যস্ত জীবন এখন অবরুদ্ধ। দুনিয়াজুড়ে শিল্প যাতে ধসে না পড়ে তার জন্য লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের প্রশাসন বিশাল অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমেরিকায় ১ লক্ষ কোটি ডলারের আর্থিক প্যাকেজ এবং ব্রিটেনে ৩৫ হাজার কোটি পাউন্ডের প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
রাতের মায়াবি আলো আছে। কিন্তু জনমানুষের দেখা নেই। করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে নিউইয়র্কের চেনা ছবি। এই মার্কিন প্রদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৭০০-র বেশি মানুষ। আশঙ্কা, আরও বাড়তে পারে এই পরিসংখ্যান। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে নিউইয়র্কের সব হাসপাতালকে।
করোনা আতঙ্কে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ অদৃশ্য মধ্যপ্রাচ্যেও। দুবাইয়ের রাজপথ এখন ফাঁকা। চিনের পাশাপাশি এশিয়ার অন্য দেশগুলিও করোনার ত্রাসে কাঁপছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বাসিন্দাদের দেশের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখনও অবধি এই দেশে ১১৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ২৬ জন।
ঘরবন্দি ছবি হংকংয়েও। অতিমারি এড়াতে চিনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেছে তারা। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চিনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সীমান্ত। চিনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে রেল, সড়ক ও ফেরি যোগাযোগও বন্ধ। সাবধানতার জন্য বন্ধ করা হয়েছে স্কুল। অন্যান্য শহরের মতো এখানেও তীব্র ধাক্কা খেয়েছে বাণিজ্য।
পর্যটন এবং বাণিজ্যের কেন্দ্র সিঙ্গাপুরও করোনা-কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত। এখানে ২৪৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। দেশবাসীর স্বার্থে সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করেছে প্রশাসন।
চিনের পরেই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত এশিয়ার দেশ হল ইরান। এখনও অবধি সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন ১১৩৫ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৩৬১ জন। প্রশাসনের তরফে দেশবাসীর কাছে আবেদন করা হয়েছে ভিড় এড়িয়ে চলতে। দেরিতে হলেও জনগণ সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে পরিস্থিতি।
ভারতের মধ্যে সবথেকে বেশি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মহারাষ্ট্রে। মারা গিয়েছেন এক জন। দিল্লি ও কর্নাটকের কলবুর্গীর দুই প্রবীণের পরে মুম্বইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুবাইফেরত ৬৩ বছরের এক বৃদ্ধ। করোনার জেরে মুম্বইয়ের রাজপথ থেকে উধাও তার চিরচেনা ব্যস্ততা।