আর পে কমিশনের অপেক্ষা নয়। এ বার দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বাড়বে বেতন? কিংবা মুদ্রাস্ফীতির সূচকের উপর নির্ভর করবে বেতনের হ্রাস-বৃদ্ধি? সূত্রের খবর, সেই লক্ষ্যেই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। যদিও এই ইস্যুতে সরকারি ভাবে এখনও কোনও ঘোষণা করেনি কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক।
গত কয়েক মাস ধরেই অষ্টম বেতন কমিশনের দাবিতে সরব রয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা। এই নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় প্রশ্নের মুখে পড়েন কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধরি। জবাবে তিনি বলেন, এখনই বেতন কমিশন তৈরির কোনও পরিকল্পনা করছে না সরকার। এর পরেই কর্মচারীদের দক্ষতা বা মুদ্রাস্ফীতির সূচকের উপর নির্ভর করে বেতনবৃদ্ধির জল্পনা শুরু হয়ে যায়।
সূত্রের খবর, এই ইস্যুতে প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে মুখ খুলেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা। কী ভাবে বেতন কমিশনকে তুলে দিয়ে কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষা করা যায়, সে দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। যদিও নতুন পদ্ধতি বেতন কমিশনের আদৌ পরিপূরক হতে পারবে কি না, তা নিয়ে আর্থিক বিশ্লেষকদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
দক্ষতাভিত্তিক বা মুদ্রাস্ফীতির উপর নির্ভর করে বেতনবৃদ্ধির সমর্থকদের যুক্তি, শেষ পর্যন্ত এই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিলে তা অবশ্যই যুগোপযোগী হবে। বেতন কমিশন সাধারণত ১০ বছর পর বসে। ফলে বেতনবৃদ্ধির জন্য এক দশক অপেক্ষা করতে হয় কর্মচারীদের। নতুন ব্যবস্থায় তার থেকে মুক্তি মিলবে।
দ্বিতীয়ত, মূলত পরিষেবা ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মচারীদের কাজ করতে হয়। তাঁদের যোগ্যতা এবং দক্ষতা নিয়ে অনেক সময়েই আমজনতার অভিযোগ থাকে। ফাইলের ফাঁসে আটকে যাওয়ায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে ভূরি ভূরি। বেতনবৃদ্ধির নতুন ব্যবস্থায় এই সমস্যার সমাধান হবে। কারণ, এ ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রমাণের নেশায় সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
সরকারি কর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে অনীহার অভিযোগ রয়েছে। অন্য দিকে পদোন্নতি নিয়ে আবার পাল্টা অভিযোগের সুর শোনা যায় সরকারি কর্মচারীদের গলায়। নতুন ব্যবস্থা চালু করা গেলে, এই দুই সমস্যা পুরোপুরি মিটে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তখন উচ্চ মেধাসম্পন্ন যোগ্য কর্মচারীদের উচ্চপদ দিতে বাধ্য হবে সরকার।
আর্থিক বিশ্লেষকেরা আবার মনে করেন, এর মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থার কর্মী এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনা সম্ভব হবে। কর্মীদের কাজের উৎসাহ বাড়াতে বেসরকারি সংস্থায় বেতনের বাইরেও ‘ইনসেনটিভ’ বা অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের প্রচলন রয়েছে। নতুন ব্যবস্থায় কতকটা সেই সুযোগই দেওয়ার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্র।
কিন্তু এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে। সমালোচকদের প্রথম প্রশ্ন, কী ভাবে বা কিসের ভিত্তিতে সরকারি কর্মচারীদের যোগ্যতা বিচার করা হবে? উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সিংহভাগই কেন্দ্রের নীতি নির্ধারণের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন। ফলে বেসরকারি কর্মীদের মতো তাঁদের রেটিং দেওয়া এক রকম অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতিতে স্বজনপোষণের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। দক্ষতার রিপোর্ট পেশের ক্ষেত্রে নিচুতলার সরকারি কর্মচারীদের থেকে অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করার সুবিধা পেয়ে যাবে পদস্থ অফিসার শ্রেণি। আর তাদের খুশি করতে গিয়ে নিয়ম-নীতি ভাঙার রাস্তায় হাঁটবেন নিচুতলার কর্মীরা। ফলে সরকারি দফতরে লাগামহীন হতে পারে দুর্নীতি।
ভারতে সরকারি চাকরিকে সুরক্ষিত কর্মসংস্থান হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। দক্ষতাভিত্তিক বেতনবৃদ্ধির নিয়ম চালু হলে, বদলে যাবে সেই সংজ্ঞা। ফলে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ কমবে যুব সমাজের। এতে দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন মধ্যমানের আধিকারিকদের উপর নির্ভর করে প্রশাসন চালাতে হবে সরকারকে।
সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে তফসিলি জাতি এবং উপজাতিভুক্তেরা কিছুটা ছাড় পেয়ে থাকেন। নতুন নিয়ম চালু করতে হলে, সংসদে পাশ করাতে হবে নতুন আইন। নরেন্দ্র মোদী সরকারের পক্ষে তা মোটেই সহজ নয়। এ ছাড়া এই পদ্ধতিতে সকলে ব্যক্তিগত সাফল্যের দিকে নজর দিলে সমষ্টিগত ভাবে ভাল কাজ করা বেশ মুশকিল হতে পারে। এতে আমজনতার পরিষেবা পেতে সুবিধার থেকে অসুবিধা বেশি হবে বলেই মনে করছে বিশ্লেষকদের একাংশ।
বর্তমান নিয়মে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা বছরে দু’বার মহার্ঘ ভাতা বা ডিএ পেয়ে থাকেন। দক্ষতার উপর নির্ভর করে বেতন ঠিক হলে, এই সুবিধা তাঁরা পাবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। পাশাপাশি, মুদ্রাস্ফীতির হার নিম্নমুখী হলে বেতন বা ডিএ কী ভাবে বৃদ্ধি করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
২০১৬ সালে সপ্তম বেতন কমিশন কার্যকর করে কেন্দ্র। ফলে সরকারের বার্ষিক খরচ এক লক্ষ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছিল। দক্ষতার বা মুদ্রাস্ফীতির হারের উপর নির্ভর করে বেতন ঠিক করলে এই বিপুল ব্যয়ভারের বোঝা কিছুটা কমবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
সপ্তম পে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ন্যূনতম বেতন সাত হাজার থেকে বেড়ে ১৮ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক মাসে আড়াই লাখ। শেষ পর্যন্ত অষ্টম বেতন কমিশন বসলে তার সুবিধা ২০২৬ সাল থেকে পাবেন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা।
সূত্রের খবর, অষ্টম বেতন কমিশন বসলে তাতে ন্যূনতম বেতন ১৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৬-৩০ হাজার টাকায় নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করা হবে। যে বিষয়গুলির উপর কর্মচারীদের মূল বেতন নির্ধারিত হয়, অর্থনীতির পরিভাষায় তাকে বলে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর। বর্তমানে এটি ২.৫৭। একে বাড়িয়ে ৩.৫ বা ৩.৮ করার দাবি উঠবে বলে জানা গিয়েছে।
এ ছাড়া অষ্টম বেতন কমিশনে বাড়ি ভাড়া ভাতা (হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স বা এইচআরএ) এবং যাতায়াত ভাড়া ভাতা (ট্র্যাভেল অ্যালাউন্স বা টিএ) বৃদ্ধির সুপারিশের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, ফের পে কমিশন বসলে কেন্দ্রের রাজস্ব ঘাটতি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। বেসরকারি ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বেতনের পার্থক্য আকাশ-পাতালের সমান হয়ে দাঁড়াবে। এতে ঘরোয়া অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অষ্টম বেতন কমিশন রাজ্য সরকারগুলিকেও বিপাকে ফেলতে পারে। কারণ, সাধারণ ভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার চেষ্টা করে রাজ্য। কিন্তু রাজ্য সরকারের হাতে কেন্দ্রের মতো বিপুল আয়ের সুযোগ নেই। ফলে রাজ্যগুলির রাজস্বের উপর চাপ বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের অবশ্য দাবি, আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) পয়লা জানুয়ারি থেকে অষ্টম পে কমিশন চালু হওয়া উচিত। দ্রুত ওই কমিশন বসাতে মোদী সরকারকে অনুরোধ করেছে ‘অল ইন্ডিয়া স্টেট গভর্মেন্ট এমপ্লয়িজ় ফেডারেশন’ নামের কর্মচারী সংগঠন। বেতন কমিশন না কি দক্ষতা ও মুদ্রাস্ফীতির উপর ভিত্তি করে বেতনবৃদ্ধি? শেষ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র, সেটাই এখন দেখার।