দক্ষিণ ইটালির প্রাচীন অস্কান ভাষায় ‘পম্পে’ শব্দের অর্থ পাঁচ। সেখান থেকেই পম্পেই শব্দের উৎপত্তি। মনে করা হয় পাঁচটি গ্রামের সমাহার থেকেই এই নামটি এসেছিল। আবার অনেকের মত, প্রাচীন রোমের পম্পেইয়া পরিবার এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল। তার থেকেই ‘পম্পেই’ শব্দের উৎপত্তি।
যেখান থেকেই শব্দের জন্ম হোক, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিল রোমান নগরী পম্পেই। রাতারাতি সেই জনপদ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতে। পুরু ছাইয়ের প্রলেপ এবং পিউমিস স্টোনে ঢাকা পড়েছিল শহর। আজও প্রস্তরীভূত পম্পেই অপেক্ষা করে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকেই পম্পেই নগরীতে জনবসতির গোড়াপত্তন। খ্রিস্টের জন্মের ৮৯ বছর আগে পম্পেই হয়ে ওঠে রোমান সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। পম্পেইবাসীর প্রধান ভাষা হয় লাতিন।
ছোটখাটো ভূমিকম্পের সঙ্গে প্রথম থেকেই পরিচিত ছিল পম্পেই-এর বাসিন্দারা। কিন্তু ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছিল, তার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি নগরীর মানুষ।
ঠিক কবে এই ভয়াল বিপর্যয়ের গ্রাসে পম্পেই তলিয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায় না। সমকালীন নথি থেকে মনে করা হয় সেই দিনটি ছিল অগস্ট বা অক্টোবরের একটি দিন।
রিখটার স্কেলে ভূকম্পনের তীব্রতা ছিল ৫ থেকে ৬-এর মাঝামাঝি। সেইসঙ্গে ভয়াল রূপ ধারণ করে আগ্নেয় পর্বত ভিসুভিয়াস। ১৩ থেকে ২০ ফিট অবধি ভলক্যানিক অ্যাশ এবং পিউমিস স্টোনের প্রলেপে ঢাকা পড়ে প্রায় কুড়ি হাজার মানুষের ঠিকানা, ১৬০ থেকে ১৭০ হেক্টর ভূখণ্ডের পম্পেই নগরী।
টানা দু’দিন ধরে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। প্রথম দফায় ১৮ ঘণ্টা ধরে পিউমিস রেন চলেছিল। এই বর্ষণে আগ্নেয় পর্বতের ভিতর থেকে ছাই এবং পিউমিস পাথরের স্রোত ঢেকে ফেলে পম্পেইকে। অধিকাংশ পম্পেইবাসী পালাতে পারলেও বহু হতভাগ্যর সমাধি হয় ছাইয়ের নীচে।
আজ পর্যন্ত পম্পেই থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রায় ১১৫০টি প্রস্তরীভূত কঙ্কাল। তাদের অবস্থান দেখে বোঝা যায় আচমকা বিপর্যয় ধেয়ে আসায় তাঁরা পালানোর সুযোগ পাননি। বা, পালাতে গিয়েও মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছেন। ছাই আর পাথরের আঁধিতে হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। ধীরে ধীরে তাঁদের উপর জমেছে আগ্নেয়ছাইয়ের আস্তরণ।
বহু কঙ্কালের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে সেই সময়কার অলঙ্কার। উদ্ধার হয়েছে প্রাচীন রোমান মুদ্রাও। ঐতিহাসিকদের ধারণা, হয়তো পালানোর সময় পম্পেইবাসী সঙ্গে রাখতে চেয়েছিলেন মূল্যবান জিনিসপত্র। কিন্তু পালানোর পথ বন্ধ করে দিয়েছিল মাউন্ট ভিসুভিয়াস। পরে কঙ্কালগুলির আধারে প্লাস্টার অব প্যারিসের সাহায্যে দেহের আকার দেওয়া হয়।
এর পর লোকচক্ষুর আড়ালে পম্পেই পড়ে ছিল নিথর ইতিহাস হয়ে। ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্বিক জিনিসের খোঁজে কয়েক জন উৎসাহী এসে পৌঁছন ইটালির কাম্পানিয়া প্রদেশে। তাঁদের উদ্যোগে পম্পেইয়ের ধ্বংসস্তূপে শুরু হয় খনন।
এই ইতিহাস-আগ্রহীরা বিস্মিত হয়ে দেখেন, ভিসুভিয়াসের লাভার ছাই আসলে সংরক্ষকের কাজ করেছে। ছাইয়ের আস্তরণে পম্পেইয়ের সব কিছু অবিকল রয়েছে দু’হাজার বছর ধরে। প্রাচীন পম্পেইয়ের ঘরবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে যেমন ছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে।
পম্পেইয়ের পাথর বাঁধানো পথে ছাইয়ের প্রলেপের নীচে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল নিত্য ব্যবহার্য জিনিস। প্রত্নবিদরা বিস্মিত হয়ে যান পম্পেই-এর বাড়িতে দু’হাজার বছরের প্রাচীন শুকনো ফল আর পাউরুটি দেখে।
গত তিনশো বছর ধরে পম্পেই নগরীর ভগ্নাবশেষে চলছে খনন এবং অনুসন্ধান। পম্পেই নিয়ে গবেষণার নতুন নতুন দিক খুলে দিয়েছে নতুন নতুন প্রত্ন-আবিষ্কার। ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইট পম্পেই-এর ধ্বংসাবশেষে প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটকের পা পড়ে।
পম্পেই-এর ধ্বংসাবশেষ থেকে চুরির অভিযোগ ছিল বহু দিন ধরেই। পর্যটকরা অনেকেই স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নিয়ে যেতেন এখানকার প্রত্নসম্পদ। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা, পম্পেইয়ের জিনিস বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর ভৌতিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন। পরে বাধ্য হয়ে আবার সেগুলি তারা ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন পম্পেইয়ে।
ভৌতিক পরিচয় পাওয়া এই পম্পেই আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে ছিল রোমান সভ্যতার প্রাচুর্যের আদর্শ উদাহরণ। ইতিহাসবিদদের মত, আধুনিক নাগরিক জীবনের সব উপকরণ মজুত ছিল পম্পেইবাসীর জীবনে। শ্রেণিবিভাজনের ছাপও ছিল স্পষ্ট।
পম্পেই-এর ধ্বংসাবশেষে পরীক্ষা করা হয়েছে সেই সময়কার রেস্তোরাঁর নর্দমাপথ। দেখা হয়েছে, শৌচাগারের প্রস্তরীভূত মানববর্জ্যও। সব মিলিয়ে গবেষকদের ধারণা, দু’হাজার বছর আগে এই রোমান শহরবাসীর খাদ্যতালিকা ছিল বৈচিত্রপূর্ণ। সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসে অলিভ, বিভিন্ন রকম বাদাম, পল, নুন দিয়ে জারিত মাছ-মাংসের প্রাধান্য ছিল। অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে যেমন খাদ্যাভ্যাস হয়ে থাকে।
কিন্তু আসল চমক ছিল অভিজাত পম্পেইবাসীর খাদ্যতালিকায়। সেই তালিকা শাসন করত বিভিন্ন সামুদ্রিক জীব এবং জিরাফ! কারণ পম্পেইয়ের বেশ কিছু রেস্তোরাঁর ভগ্নস্তূপের নর্দমায় পাওয়া গিয়েছে জিরাফের পায়ের হাড়। পরীক্ষার পর গবেষকদের ধারণা, অভিজাতদের খাওয়ার জন্যই জিরাফ ব্যবহৃত সেই পম্পেই নগরীতে।
স্তাবিয়ে-সহ অন্যান্য বন্দর দিয়েই জিরাফের মাংস-সহ অন্যান্য মহার্ঘ্য খাবার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমদানি করা হত বলে ধারণা ইতিহাসবিদদের। ইন্দোনেশিয়া থেকে আসত বিভিন্ন মশলাপাতি। সব বৈভব এবং বৈচিত্র নিয়েই ভিসুভিয়াসের কাছে আত্মসমর্পণ করে পম্পেই। (ছবি:শাটারস্টক)