বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ। ছবি: এএফপি।
নানা অনিশ্চয়তা সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়েছিলাম ৯ অগস্ট রাতে। গন্তব্য হংকং। জুন মাস থেকে আমার স্বামী চাকরিসূত্রে সেখানে। দু’মাস পরে মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি ওর কাছে। অশান্তির খবর তো পড়ছিলামই। কলকাতায় বসে ব্যাগ গোছানোর সময়েই সতর্ক ছিলাম, সাদা বা কালো পোশাক যেন নিয়ে না ফেলি। কারণ, হংকংয়ে এখন কালো মানেই প্রতিবাদের রং, সাদা সরকারপক্ষের। রাস্তাঘাটে হামেশাই দু’দলের মধ্যে হাতাহাতি বেধে যাচ্ছে।
কলকাতা বিমানবন্দর থেকেই জানলাম যে পরের দিন, মানে আমাদের পৌঁছনোর দিন সকাল থেকেই হংকং বিমানবন্দরে গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদীদের বিরাট জমায়েত হওয়ার কথা। বিমান উড়ল যথাসময়ে। ১০ তারিখ সকালে সমুদ্র-ঘেঁষা রানওয়ে ধরে নেমেও পড়লাম। আমার চোখ আটকে গেল মেঝের একটা অংশে— প্রায় শ’তিনেক নানা সাইজের পোস্টার। সেগুলো জুড়ে জুড়ে কোলাজ তৈরি করছেন যুবক-যুবতীরা। গণতন্ত্রের দাবি আর হংকং বাঁচানোর আর্জি সে সব পোস্টারে মিলেমিশে একাকার। সবার পরনে কালো পোশাক। মুখ ঢাকা মুখোশে। পায়ে পায়ে ওঁদের পেরিয়ে যাওয়ার সময় বুঝিনি, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওঁরা সারা পৃথিবীর শিরোনাম হতে চলেছেন!
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে হংকং আইল্যান্ড ঘুরে কাউলুন-এ বাড়িতে পৌঁছলাম নির্বিঘ্নেই। বিকেলে শহর দেখতে বেরোলাম দোটানা নিয়েই। কারণ, দিনটা শনিবার। গত দু’মাস ধরে এ শহরে সপ্তাহান্ত হলেই রাস্তায় সরকার বিরোধী প্রতিবাদের ঢল নামে। ৭০ লক্ষ জনসংখ্যার হংকংয়ে কোনও সপ্তাহে ৩ লক্ষ, কোনও সপ্তাহে ৫ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নামেন। তখন দোকানপাট-গাড়িঘোড়া-বাস-ট্রেন বন্ধ।
সে দিন বিকেলে টাইমস স্কোয়ারের জনসমুদ্র অবশ্য ফুর্তির মেজাজে। আট থেকে আশি যেন ফিরে পেতে চাইছে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। রাস্তার ধারের জায়ান্ট স্ক্রিন তার মধ্যেই হঠাৎ বেসুরো— তাই পো-তে পুলিশ-জনতা খণ্ডযুদ্ধ চলছে। রওনা দিলাম বাড়ির দিকে। আগেই শুনেছি, এ রকম গোলমাল হলেই অবস্থান বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। এমন কিছু জায়গা বেছে নেওয়া হয়, যাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সমুদ্রের তলায় সুড়ঙ্গ তার অন্যতম। কাউলুন বাদে গোটা হংকংই কয়েকটা ছোট-বড় দ্বীপের সমষ্টি। সুড়ঙ্গপথই যোগাযোগের মাধ্যম।
মেট্রো স্টেশনের দিকে এগোতে গিয়েই দেখি, সামনে আপাদমস্তক কালোয় মোড়া ৩০-৪০ জনের একটা দল। চোখে ডুবুরিদের মতো চশমা, মাথায় হেলমেট, মুখে মুখোশ। সবই কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য। আমাদের দিকে বিন্দুমাত্র না তাকিয়ে ওঁরা চলে গেলেন।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে একটা দোকানে দাঁড়িয়েছি কিছু জিনিস কিনব বলে। দোকানি ব্যস্ত হয়ে ঝাঁপ ফেলে বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি যান। গোলমাল হতে পারে। ছুট লাগালাম। আলো নিভে যাচ্ছে রাস্তার, পরপর ঝাঁপ পড়ছে। রাস্তায় নামতে শুরু করল রায়ট-পুলিশ। হাতে বড় বড় কাচের ঢাল। বাড়িতে ঢোকার আগে চোখে পড়ল, পাশে প্রিন্স এডওয়ার্ড মেট্রো স্টেশনের দরজা বন্ধ। রাত দশটায় মেট্রো তো বন্ধ হয় না! পরে খবর এল, আমরা যখন রাস্তায় ছুটছিলাম, তখন এডওয়ার্ড-এর পরের মেট্রো স্টেশনেই কাঁদানে গ্যাস চলেছে!
চার দিন কাটিয়ে বুঝলাম, ছবির মতো সাজানো-গোছানো হংকং এখন এ রকমই। সর্বত্র অনিশ্চয়তার ছায়া। পরের রাতে কলকাতায় ফেরার উড়ান ছিল। কিন্তু বিমান চলাচল তো বন্ধ। বিমানবন্দর অবরুদ্ধ। সকালে উঠে জানলাম, বিমানবন্দরে অবস্থান-বিক্ষোভে আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে। খবরে শুনছি, ২৭ কিলোমিটার দূরে শেনঝেন-এ জড়ো হয়েছে চিনের সাঁজোয়া গাড়ি। এক রাশ মন খারাপ নিয়েই বুধবার হংকং ছাড়ছি। এখানকার মানুষজন বড় ভাল। ইংরেজি বোঝেন না তেমন। ভাষার বাধা ঠেলেই সাহায্য করতে সর্বদা উৎসুক। ওঁদের উপরে সামরিক দমনপীড়ন যেন নেমে না আসে, এই প্রার্থনা।