জামাল খাসোগি। ফাইল চিত্র।
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিল রিয়াধের একটি আদালত। ২৪ বছরের জন্য কারাদণ্ড হয়েছে আরও তিন জনের। তবে অপরাধী কারা, তাদের নাম-পরিচয় কিছুই প্রকাশ্যে আনা হয়নি। তাই সৌদি আদালতের রায় নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে— ‘দোষীদেরই’ শাস্তি হচ্ছে তো? নাকি নিরাপরাধ কাউকে ফাঁসির মঞ্চে তুলে আসল অপরাধীদের আড়াল করছে সৌদি সরকার!
একটি প্রথম সারির মার্কিন দৈনিকে সাংবাদিকতা করতেন ৫৯ বছর বয়সি খাশোগি। সৌদি যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন ওরফে এমবিএসের সমালোচক বলেই পরিচিত ছিলেন তিনি। গত বছর ২ অক্টোবর তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুলের সৌদি কনসুলেটে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার পর আর তাঁকে দেখা যায়নি। তদন্তে জানা যায়, সৌদি আরব থেকে পাঠানো একটি দল কনসুলেটেই খুন করেছিল খাশোগিকে।
এ দিন কোর্টে রায় ঘোষণার পরে সরকারি আইনজীবী বলেন, ‘‘ভয়ানক অপরাধ হয়েছিল। এটা তারই শাস্তি।’’ যদিও সৌদি সরকার বিচারপক্রিয়ার পাশাপাশি সাজাপ্রাপ্তদের পরিচয়ও গোপন রেখেছে। তাতেই প্রশ্ন উঠছে, কাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল? তারা সত্যিই অপরাধী তো? রাষ্ট্রপুঞ্জের এক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, এই মৃত্যুদণ্ড ‘বিচার-বহির্ভূত’। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিভাগের বক্তব্য, বন্ধ দরজার আড়ালে বিচার চলেছে এত দিন। আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন কিছুই মানা হয়নি। বিচার প্রক্রিয়াকে আড়াল করতে যা যা করা যায়, সব চেষ্টা করেছে সৌদি প্রশাসন। তুরস্ক সরকারও সৌদি আদালতের রায়ের নিন্দা করে বলেছে, ‘‘আঙ্কারা বা আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি যা আশা করেছিল, তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি ওরা। বিচার ওরা করেনি।’’
খাশোগি-হত্যার তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছিল, শ্বাসরোধ করে মেরে দেহটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে রাসায়নিকে মিশিয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছিল সৌদি হিট-টিম। খাশোগিকে হত্যার শেষ মুহূর্তের একটি অডিয়ো টেপ তদন্তের সময়ে প্রকাশ্যে আসে। তাতে প্রবীণ সাংবাদিকের আর্তনাদ, করাতে তাঁর দেহ কাটার আওয়াজ, শোনা গিয়েছিল সবই। একটি ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা যায়, দু’টো কালো রঙের ব্যাগ নিয়ে একটি লোক ইস্তানবুলের সৌদি কনসাল জেনারেলের বাড়িতে ঢুকছে। তুরস্কের সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, ওই ব্যাগ দু’টিতে খাশোগির দেহাবশেষ ছিল। লোকটি সৌদি ‘হিট টিম’-এর সদস্য। আরও দাবি করা হয়, পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয়েছে খাশোগিকে। এবং এর পিছনে রয়েছে সৌদি প্রশাসনের বড় মাথারা, এমনকি এমবিএসও। শোনা যায়, তাঁরই নির্দেশে খুন করা হয়েছিল খাশোগিকে।
এমবিএসের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা উচিত বলে দাবি তুলেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ তদন্তকারী অফিসার অ্যাগনেস ক্যালামার্ড। কিন্তু এমবিএস অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে অবশ্য একটি মার্কিন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের দায় সম্পূর্ণ তাঁরই। বলেন, ‘‘সৌদি প্রশাসনের লোকজনই জড়িত ছিলেন। অতএব এর দায়ভার আমার কাঁধেই বর্তায়।’’ যদিও এমবিএস স্পষ্ট জানিয়ে দেন, খুনের নির্দেশ তিনি দেননি। অর্থাৎ কি না তাঁর দাবি অনুযায়ী, তাঁর অজ্ঞাতে তাঁরই প্রশাসনের লোকজন যুবরাজের অন্যতম সামলোচক খাশোগিকে ঠান্ডা মাথায় নিকেশ করেছিল।
এক সৌদি সরকারি আইনজীবী শালান শালান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, খাশোগিকে খুন করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। ঠিক ছিল ওই দলটি গিয়ে যে কোনও ভাবে খাশোগিকে দেশে ফিরিয়ে আনবে। শালান জানান, খাশোগিকে জোর করা হলে তিনি বাধা দেন। এর পরে তাঁকে অজ্ঞান করতে একটি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল। সেই ওষুধের মাত্রা বেশি হয়ে যাওয়ায় খাশোগি মারা যান। এর পর দেহ লোপাট করা হয়। শালানের দাবি, যুবরাজ কিছু জানতে না।
খাশোগি-খুনে জড়িত সন্দেহে ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গত জানুয়ারি মাসে রিয়াধের অপরাধ দমন আদালতে বিচার শুরু হয়। এর মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানান সরকারি আইনজীবী। কিন্তু জুন মাসে নিজস্ব তদন্তের পরে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ তদন্তকারী অফিসার অ্যাগনেস বলেন, অভিযুক্তেরা সৌদি গুপ্তচর। তারা যা করার ‘সিনিয়র’দের নির্দেশে করেছিলেন। সিনিয়রদের নির্দেশ না মানা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব আসল অপরাধীরা হয়তো আড়ালেই।