গোপীনাথ।—ফাইল চিত্র।
বারদোলের আগে গোপীনাথ বিগ্রহকে নিয়ে অগ্রদ্বীপ ও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মধ্যে টানাটানির সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হল বর্ধমান জেলা প্রশাসন।
কুলদেবতা গোপীনাথের উপস্থিতেই বারদোল উৎসব পালন করেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বংশধরেরা। প্রতি বছর পুজোর পরে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে চুক্তিপত্রে সই করে গোপীনাথ বিগ্রহ গ্রামে আনেন ‘অগ্রদ্বীপ গ্রামের বিশিষ্টজনেরা’। কিন্তু এ বছর ওই বিগ্রহ কৃষ্ণনগরে পাঠাতে নারাজ অগ্রদ্বীপের বাসিন্দারা। ১১ এপ্রিল বারদোল উৎসবের আগে কুলদেবতা যাতে তাঁদের কাছে ফিরতে পারেন, সে জন্য প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি। সোমবার দুপুরে বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন, মহকুমাশাসক মৃদুল হালদার, অগ্রদ্বীপ গোপীনাথ ট্রাস্টের সদস্য ও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রতিনিধিদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয়। জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “আমরা দু’পক্ষর কাছেই বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছি। মঙ্গলবারের মধ্যে লিখিত ভাবে জবাব দিতে বলা হয়েছে। তা পাওয়ার পরে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
এ দিন বৈঠকের শুরুতে অগ্রদ্বীপ গোপীনাথ ট্রাস্টের সম্পাদক জহর দে জেলাশাসককে জানান, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ ভূমিপুত্র। তাঁকে কোনও মতে ছাড়া হবে না। এ ছাড়াও তাঁরা অভিযোগ করেন, গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধমেলা ও অন্য সময় গোপীনাথ মন্দিরে যে প্রণামী পড়ে তাঁর কোনও হিসেব নেই। তা থেকে মন্দিরের কোনও উন্নয়ন হয় না। জীর্ণ মন্দির সংস্কার করতে গেলে রাজবাড়ি থেকে বাধা আসে। প্রথা অনুযায়ী, গোপীনাথ বিগ্রহ সাত মাস কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে থাকেন। বাকি পাঁচ মাস অগ্রদ্বীপের মন্দিরে। কথিত আছে, চৈতন্যদেব অগ্রদ্বীপে ভাগীরথীর তীরে গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বিগ্রহ দেখাশোনার ভার দিয়ে যান তাঁর অন্যতম পার্ষদ গোবিন্দ ঘোষকে। কথিত রয়েছে, গোবিন্দ ঘোষের ইচ্ছা ছিল তাঁর মৃত্যুর পরে গোপীনাথ যেন পিন্ড দান করেন। সেই মতো প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার কৃষ্ণা একাদশীতে মন্দির থেকে গোপীনাথ বিগ্রহকে গোবিন্দ ঘোষের সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গোপীনাথ পিন্ড দান করে ফের মন্দিরে ফিরে আসেন। এই মেলার পরের একাদশীতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গোপীনাথকে ঘিরে হয় বারদোল মেলা।
এ দিনের বৈঠকে কৃষ্ণনগর রাজ পরিবারের ম্যানেজার গৌতম মালাকার কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা এই প্রথা যাতে চালু থাকে সে জন্য প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানান। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, চুক্তি করে বিগ্রহ এনেছিলেন অগ্রদ্বীপের বাসিন্দারা, বৈঠকে সে প্রসঙ্গ ওঠে। সেখানে গৌতমবাবু জানান, চুক্তি অনুযায়ী ৮ এপ্রিল অগ্রদ্বীপ থেকে গোপীনাথ বিগ্রহ কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে যাওয়ার কথা। ওই চুক্তি মানতে অস্বীকার করে বিশ্বাসভঙ্গ করছেন বলে অভিযোগ করেন গৌতমবাবু। এর আগে কাটোয়া মহকুমাশাসক দফতরেও দু’পক্ষের মধ্যে বৈঠক হয়েছিল। তার পরে অগ্রদ্বীপ গোপীনাথ ট্রাস্টের পক্ষে ৫৯৯৮ জনের সই সম্বলিত চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয়, তাঁরা কোনও মতে গোপীনাথকে ছাড়বেন না। মহকুমাশাসক মৃদুল হালদার এ নিয়ে জেলাশাসককে রিপোর্ট পাঠান।
ওই রিপোর্ট পাওয়ার পরে জেলাশাসক দু’পক্ষকে ডেকে ফের বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন। এ দিন জেলা প্রশাসনের তরফে দু’পক্ষের কাছে যে সব প্রস্তাব রাখা হয় সেগুলি হল, বিগ্রহ নিয়ে যে প্রথা চলে আসছে তা বজায় থাকুক। প্রশাসনের তরফে স্থানীয় মানুষজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। মন্দিরে প্রণামী বাবদ যা টাকা-গয়না পড়বে তার জন্য বর্ধমান ও নদিয়ার জেলাশাসকদের তত্ত্বাবধানে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। হিসেবে স্বচ্ছতা আনতে নিয়মিত অডিট করানো হবে। প্রণামীর টাকা মন্দির উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে ব্যয় করা হবে। প্রয়োজনে সমস্ত ব্যাপারটাই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হবে। বিগ্রহ যাওয়া-আসার ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করবেন বর্ধমান ও নদিয়ার জেলাশাসক।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বর্তমান বংশধর সৌমিশচন্দ্র রায় বলেন, “আমরা ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। আমরা চাই না কোনও প্রথা নষ্ট হোক। জেলাশাসকের প্রস্তাবে আমরা খুব খুশি।” তবে অগ্রদ্বীপ এই প্রস্তাব মানতে রাজি নয়। জহরবাবু বলেন, “জেলাশাসকের প্রস্তাব আমরা মানতে পারছি না। প্রথা মেনে আর কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গোপীনাথকে পাঠাব না, সে কথা জেলাশাসককেও বলে এসেছি।”