গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির একটি আবাসনের পুজো ঘিরে শুরু হল বিতর্ক। মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বৃহস্পতিবার ওই আবাসনের পুজোর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ নিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট করেন। সেখানে তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ, ওই আবাসনের পুজো উদ্যোক্তারা এমন কিছু কাণ্ড ঘটিয়েছেন, যাতে মিলনের উৎসব দুর্গাপুজো পরিণত হয়েছে বিভাজনের উৎসবে। রত্নাবলী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কলকাতার একটু প্রান্তে’ ‘বড়লোক’ আবাসনে বিশেষ সম্প্রদায়ের কিছু ছোট ছেলেমেয়েকে ঠাকুর দেখতে দেওয়া হয়নি। অথচ, তাদের খুশির উৎসব এলেই, আমরা ‘অ্যাই বিরিয়ানি খাওয়াও’ বলে হ্যাংলামি করি, বাড়িতে অনিমন্ত্রিত হয়ে প্রায় চড়াও হই! সেই একই আবাসনের অন্য এক জন স্বামীহারা মহিলাকে ঠাকুর বরণ থেকে বিরত করা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘আপনি তো বিধবা’! কিন্তু পুজোয় তাঁর মোটা টাকা চাঁদা হাত পেতে নিয়েছে আবাসনের পুজো কমিটি। যে পুজোয় বা উৎসবে সবার সামিল হবার অধিকার নেই, সেই উৎসব খুব সেকুল্যার (ধর্মনিরপেক্ষ) বা কমিউনিটি কেন্দ্রিক, সে সব বলা বন্ধ হোক।’
ঘটনা নিয়ে ওই আবাসনেরই এক বাসিন্দার অভিযোগ, ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা, তিনি বিধবা। বৈধব্যের কারণে তাঁকে প্রাথমিক ভাবে ষষ্ঠীর দিন বরণ করতে দেননি ওই আবাসন কর্তৃপক্ষ। পরে এই নিয়ে আবাসনের অন্য মহিলারা প্রতিবাদ করায় শেষে সুযোগ পেয়েছেন ওই মহিলা। কিন্তু উল্টো দিকে এটাও সত্যি যে ওই মহিলা এই পুজো মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়েছেন, তিনি এই পুজোর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। আর তিনি কেবলমাত্র বিধবা বলে তাঁকে সামাজিক উৎসব থেকে প্রাথমিক ভাবে কার্যত বয়কট করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তিনি সুযোগ পান। যদিও ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি ওই আবাসনের পুজো উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি, ওই বাসিন্দার অভিযোগ, তিনি দেখেছেন, দুর্গাপুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি অহিন্দু শিশুদের।
আনন্দবাজার অনলাইনের পক্ষ থেকে ফোন করা হলে আবাসনের অন্য এক বাসিন্দা বলেছেন, ‘‘এমন কোনও ঘটনা ঘটে থাকলে তা অবশ্যই দুঃখজনক। একুশ শতকে এসেও এমন ঘটনা লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে দীর্ঘ দিন ধরে এই আবাসনে পুজো চলে আসছে। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। যদি কোনও কারণে এমন অভিযোগ উঠে থাকে, তা সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আমাদের এই বিষয়ে আর কিছু বলার নেই।’’
তবে আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে রত্নাবলী রায় জানিয়েছেন, ‘‘এক দিকে যখন অর্ধনারীশ্বরের কথা বলে আমরা নিজেদের প্রগতিশীল বলার চেষ্টা করছি, সেখানে এই ধরনের ঘটনা বিভাজন খোঁজা সংকীর্ণ রাজনীতিকেই প্রকাশ করে। ভিন্ধর্মের মানুষদের আয়োজিত পুজোর ফর্দ দেওয়া শুরু হয়েছে। কেন এটা আলাদা করে উল্লেখ করা হচ্ছে? মহিলাদের আয়োজিত পুজোর দিকে তাকালেও দেখবেন, পুজোয় মাতছেন উচ্চবর্ণের মহিলারা। নিম্নবর্ণের মহিলাদের অংশগ্রহণ কোথায়? এই ধরনের মানসিকতা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির সঙ্গে মোটেই যায় না।’’
ফেসবুকে এই নিয়ে পোস্ট করেছেন সমাজকর্মী দোলন গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, ‘‘যদি এটা সত্যিকারের সকলের উৎসব হয়, তা হলে সমস্ত সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের যোগদানের সমান অধিকার থাকা দরকার। এক দিকে যদি দুর্গাকে আমরা নারীকে ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসাবে আমরা দেখি, যার মধ্যে সব মহিলাই আসতে পারেন, বিবাহিত-অবিবাহিত, রূপান্তরিত, দলিত, মুসলমান নারীও আসবেন। কিন্তু যদি আমরা স্পষ্ট এটাই বলি যে এটি এমন এক ধর্মীয় উৎসব যা মানুষদের বাদ দেওয়ার কথা বলে। স্পষ্ট করে বলা উচিত যা বলার।’’