সরোবরের জলে নেমে চলছে ছটপুজো। ফাইল চিত্র
পরিবেশের স্বার্থ রক্ষার বিরুদ্ধ-স্রোতে গিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজোর অনুমতি আদায়ের জন্য কত লক্ষ টাকা খরচ করা হল? কেনই বা করা হল?—তা নিয়ে রীতিমতো সরব আইনজীবী ও পরিবেশবিদ মহল। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘পরিবেশ রক্ষার জন্য জাতীয় পরিবেশ আদালতের ‘না’-কে ‘হ্যাঁ’ করানোর জন্য যত টাকা গচ্চা গেল রাজ্য সরকারের, সেই টাকা পরিবেশ রক্ষার কাজে বিনিয়োগ করলে বরং লাভ হত।’’
ঠিক কত খরচ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা করা নিয়ে? এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র (কেএমডিএ) এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, ‘‘এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জায়গায় আমি নেই। ফলে এটা বলতে পারব না।’’
আইনজীবী মহলের একাংশ অবশ্য জানাচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টে ছট মামলা লড়ার জন্য আইনজীবীদের ফি ও আনুষঙ্গিক খরচ-সহ সরকারি খাত থেকে কমপক্ষে ১০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এক আইনজীবীর কথায়, ‘‘সব থেকে কম খরচও যদি ধরা যায়, তা হলেও সেটা ১০ লক্ষের কম কিছুতেই হবে না। কারণ, শুনানি পিছু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের ফি-ই অনেক বেশি।’’ কেএমডিএ-র চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম আবার সরোবরে ছটপুজোর ক্ষেত্রে পরম্পরার উপরে জোর দিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন, অনেকেই তাঁর কাছে এসে জানিয়েছিলেন, তাঁরা একশো বছর ধরে রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো করছেন। যেমন, অনেকে পরম্পরাবশত একই মন্দিরে যান বা যে শ্মশানে পূর্বপুরুষদের দাহ করা হয়, সেখানেই কাউকে নিয়ে যাওয়া হয়, তেমনই ছটপুজোর ক্ষেত্রেও সেই ‘পরম্পরা’-র বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফিরহাদের কথায়, ‘‘পরম্পরার বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলাম যাতে এক বেলা সেখানে ছটপুজোর অনুমতি দেওয়া যায়। আমরা এমনও বলেছিলাম, পুজোর তেল ফেলার জন্য সরোবরে প্লাস্টিক কন্টেনার দিয়ে দেব। পুজোর আগে ও পরে সরোবরের জলের মান পরীক্ষাও করে দেখাব যে, পুজোয় কতটা দূষণ হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যখন তার পরেও অনুমতি দেয়নি, আমরা তা মেনে চলব।’’
আরও পড়ুন: শেষ বেলায় ধরা পড়ল অকেজো নজর-চোখই
এ প্রসঙ্গে অতীতের ঘটনাও টেনে আনছেন ফিরহাদ। তিনি জানাচ্ছেন, ২০১১ সালের আগে রবীন্দ্র সরোবরে নেমে সবাই স্নান করতেন। তখন যেন সরোবরে পরিযায়ী পাখিরা আসত না, জীববৈচিত্র্যের কোনও ক্ষতি হত না! ফিরহাদের কথায়, ‘‘আমরাই কিন্তু সরোবরগুলি ঘিরে সেখানে সৌন্দর্যায়ন করেছি, তা রক্ষার চেষ্টা করছি।’’
যদিও রাজ্য সরকারের এই যুক্তি মানতে চাইছেন না আইনজীবী ও পরিবেশবিদদের একটি বড় অংশই। আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘একটা ‘না’-কে ‘হ্যাঁ’ করানোর প্রচেষ্টায় সরকার যে টাকাটা খরচ করল, সেটা তো সাধারণ মানুষের করের টাকা!’’
আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ‘জয় পরিবেশের’, বলছেন পরিবেশ কর্মীরা
প্রশাসন সূত্রের খবর, ছটপুজোর কারণে অস্থায়ী আলো, পরিকাঠামোগত সহায়তা-সহ একাধিক কারণে এখনও পর্যন্ত ৪৯ লক্ষ ৪২ হাজার ২৯১ টাকা খরচ হয়েছে। এক পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘এই খরচটা প্রাসঙ্গিক। কারণ, ছটপুজোর ঘাটগুলিতে আলোর পাশাপাশি অন্য ব্যবস্থাও তো করতে হবে।’’
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘আমাদের কারও কিন্তু ছটপুজো নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই। কিন্তু পরিবেশ নিয়ে সরকারের মানসিকতা নিয়ে আপত্তি। একই আপত্তি বিজেপি-র মনোভাব নিয়েও। বিহারি-সহ অবাঙালি ভাষাভাষী ভোট যখন গত লোকসভা নির্বাচনে তাদের পক্ষে গিয়েছে, তখন এ বিষয়ে আরও সদর্থক ভূমিকা পালনের দরকার ছিল।’’
পরিবেশ সংক্রান্ত মামলার আইনজীবী পৌষালি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাব যে ভাবে সর্বত্র পড়ছে, তা পরিষ্কার। তাই পরিবেশকে অগ্রাহ্য করলে হবে না।’’ পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-এর সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, ‘‘বিহারি-সহ অবাঙালি ভাষাভাষীদের পরিবেশ সচেতন একটি অংশও কিন্তু সরোবরে ছটপুজোর বিপক্ষে। কারণ, পরিবেশ কোনও নির্দিষ্ট জাতি-ধর্মের নয়।’’