বারবার ক্ষোভের মুখে কেন শতাব্দী রায়? কোথায় ফারাক মিমি চক্রবর্তী, নুসরত জাহানদের সঙ্গে? — ফাইল চিত্র।
পর্দার নায়িকা রাজনীতির ময়দানে নামলে খাতির পাওয়ারই কথা! যেমন পেয়ে থাকেন যাদবপুরের সাংসদ মিমি চক্রবর্তী বা বসিরহাটের নুসরত জাহান। কিন্তু সাংসদ শতাব্দী রায়কে ঘিরে কথায় কথায় এত বিক্ষোভ দেখান কেন বীরভূমের মানুষ?
রবিবারই পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে সিউড়িতে জনতার ‘ক্ষোভ’-এর মুখে পড়তে হয় শতাব্দীকে। গ্রামবাসীরা অভিনেত্রী-সাংসদকে ঘিরে ধরে অনেক কথা বলতে থাকেন। শতাব্দী অবশ্য হাসিমুখেই ছিলেন। অতীতেও কর্মী থেকে ভোটারদের এমন ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে শতাব্দীকে ঘিরে। কিন্তু কেন?
শতাব্দী অবশ্য একে আদৌ ‘ক্ষোভ-বিক্ষোভ’ বলে মানতেই নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে এটা কী শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপরে নির্ভর করে। সাধারণের আর্জি বা অনুরোধকে যদি সংবাদমাধ্যম ক্ষোভ-বিক্ষোভ বলে, তবে আর আমার কী করার আছে?’’ রবিবার সিউড়ি-১ ব্লকে ভোটপ্রচারের সময় তাঁকে ঘিরে ক্ষোভ উগরে দেন গ্রামবাসীরা। দাবি ছিল, এলাকায় পানীয় জলের ভাল বন্দোবস্ত চাই। অনেকে আবাসের বাড়ি পাননি। বর্ষায় ভাঙাবাড়ির ফুটো চাল দিয়ে জল পড়ছে। কিন্তু পঞ্চায়েত অফিস থেকে ত্রিপলও মেলেনি। পাশাপাশি, গ্রামের মূল রাস্তার বেহাল অবস্থা দেখে সেই রাস্তা মেরামতের জন্য এলাকার সাংসদ শতাব্দীর কাছে লিখিত দাবি জানান তাঁরা।
এর আগে ‘দিদির দূত’ হয়েও বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার, সিউড়ি, খয়রাশোল ব্লকে গিয়ে স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন শতাব্দী। হাসন বিধানসভার একটি গ্রামে গিয়ে খাবার ফেলে উঠে যাওয়ায় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। শতাব্দী অবশ্য সেটি সংবাদমাধ্যমের ‘সাজানো ছবি’ বলেই দাবি করেছিলেন। আবার রবিবার সিউড়িতে তাঁকে ঘিরে ক্ষোভ।
তাঁকে ঘিরে সাধারণ মানুষ এত বিক্ষোভ দেখান কেন? জবাবে বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ বলেন, ‘‘আমি উল্টো বলি, সাংবাদিকরা বার বার কেন এত অসত্য বলেন? ক্ষোভ কাকে বলে, সেটা যদি আমায় বলা যায়, তবে আমি উত্তরটা দিতে পারব!’’ এর পরেই রবিবারের প্রসঙ্গ টেনে শতাব্দীর দাবি, ‘‘আমি মোট ১৮টা কর্মসূচিতে ছিলাম। তার মধ্যে এক জায়গায় বাসিন্দারা আমায় বলেছেন, তাঁরা ত্রিপল পাননি। কেউ বলেছেন, আমার গ্রামে একজন লোক আবাসে চারটে বাড়ি পেয়েছে। আমি একটাও পাইনি। এটাকে ক্ষোভ বলে কি? আমাকে আগে এর উত্তর দিতে হবে।’’ শতাব্দীর সংযোজন, ‘‘বাংলা ভাষায় এগুলোকে ‘আর্জি’ বলে। ‘ক্ষোভ’ বলে না।’’
তিনি অভিনেত্রী বলেই কি একটু বেশি মানুষের ভিড় হয়? শতাব্দীর বক্তব্য, ‘‘সেটা তো হয়ই। বেশি ভিড় যেমন হয়, বেশি ভালবাসাও তেমনি মেলে। একজন রাজনীতিকের সঙ্গে সবাই যে ভাবে কথা বলেন, আমার সঙ্গে সে ভাবে বলেন না। ওঁরাই বলেন, এগুলো ক্ষোভ নয় দিদি। আবেদন। কালকেই (রবিবার) যেমন রাস্তার জন্য টাকা চাইছিলেন। আমি বললাম, যদি বলেন ২ লাখ টাকা আমি এখনই দিয়ে দেব। কিন্তু যদি বলেন ২ কোটি টাকা, তবে আমি পারব না।’’ একই সঙ্গে শতাব্দী বলেন, ‘‘ক্ষোভ কাকে বলে আমি জানি। কিন্তু জোর দিয়েই বলছি, বীরভূমের মানুষ আমায় এখনও পর্যন্ত কখনও ক্ষোভ দেখাননি। ২০০৯ থেকে এখনও পর্যন্ত একই রকম ভালবাসা পেয়ে চলেছি।’’
শতাব্দী জানান, তাঁকে রাস্তায় দেখলে এমনিতেই ভিড় হয়। অনেকেই কাছে এসে হাত মেলাতে চান। ইদানীং নিজস্বী তোলার ভিড়ও হচ্ছে। শতাব্দী বলেন, ‘‘মানুষ ভালবেসে আমায় ঘিরে ধরেন। সেটাকেই কিছু সংবাদমাধ্যম ক্ষোভ-বিক্ষোভ বলে দেখায়।’’
জেলা বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য সেটা মনে করেন না। দলের বীরভূম জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহা বলেন, ‘‘মানুষ তো ক্ষোভ দেখাবেই! সারাটা বছর বীরভূমের মানুষ ‘দিদির দেখা নাইরে, দিদির দেখা নাই’ বলেছে। এখন ভোটের মুখে তিনি এলাকায় ঘুরলেই শুনতে হচ্ছে রাস্তা নাই, পানীয় জল নাই, আবাসের বাড়ি নাই। সেটা তো ভুল নয়। আর সেটা নিয়েই সাংসদের উপরে মানুষের ক্ষোভ।’’
কিন্তু তিনি তো শাসক তৃণমূলের একা ‘সেলিব্রিটি’ জনপ্রতিনিধি নন। মিমি, নুসরত, দেবরাও রয়েছেন। তাঁদের ঘিরে তো এত ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা যায় না? শতাব্দীর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘জানি না।’’ তবে তাঁর হিতৈষীরা বলেন, ‘‘এই তুলনাটা করাই ঠিক নয়। দিদি (শতাব্দী) যে ভাবে সর্বত্র যান, বাকিরাও কি তাই করেন? ভাঙড় তো যাদবপুর লোকসভা আসনের মধ্যে। এত গোলমাল, এত কিছুর মধ্যে কি সেখানে স্থানীয় সাংসদকে দেখা গিয়েছে? শান্তিস্থাপনের বার্তা কি দিতে দেখা গিয়েছে?’’ তাঁদের কথায়, ‘‘অন্যরা এখনও অভিনেত্রী-সাংসদ। দিদি এখন সাংসদ-অভিনেত্রী।’’
সত্যিই শতাব্দী বাকি খ্যাতনামীদের তুলনায় রাজনীতিতে প্রবীণ। টানা তিন বারের সাংসদ তিনি। দেব দু’বারের। মিমি এবং নুসরত ২০১৯ সালেই প্রথম লোকসভায় গিয়েছেন। তিন সতীর্থ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ শতাব্দীর কথায় অবশ্য তুলনার একটা হালকা আভাসও রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি আমার কাজ করি। এটুকু জানি। আমি সেলিব্রিটির তকমা না নিয়ে এলাকায় এলাকায় যাই। যে ক’টা কর্মসূচি দল দেয়, সেটা অনেকের চেয়ে যে বেশি করি, সেটা জানি।’’ এত কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ায় ক্লান্তি আসে স্বীকার করেও সাংসদ-অভিনেত্রী (অভিনেত্রী-সাংসদ নয়) শতাব্দী বলেন, ‘‘এক একদিন বের হতেই ইচ্ছা করে না। মনে হয়, আবার যাব! আবার কত কথা বলতে হবে! কিন্তু যে-ই বেরিয়ে পড়ি, তখন নতুন করে শক্তি পাই। মানুষের ভালবাসা দেখে সব ক্লান্তি চলে গিয়ে নতুন এনার্জি চলে আসে।’’