রাজ্যের সব জেলাতেই অস্ত্র কারখানার হদিস মিলছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় মঙ্গলবারের বিস্ফোরণ নিয়ে উত্তপ্ত রাজ্য রাজনীতি। অভিযোগ উঠেছে, নামে বাজি কারখানা হলেও সেখানে বাজির আড়ালে তৈরি হত বোমা। এমন আশঙ্কা শুধু বিরোধী শিবিরের নয়, শাসক শিবিরের একাংশেরও। ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিজেপির তোলা এনআইএ তদন্তের দাবিতেও তাঁর আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই ঘটনা আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের আগে ‘সিঁদুরে মেঘ’ বলে মনে করছেন রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশকর্তা পঙ্কজ দত্ত। অন্য দিকে, প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেনের বক্তব্য, বাংলা ‘মুঙ্গের’ হয়ে না গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক অস্ত্র কারখানার হদিস মেলা অশুভ সঙ্কেত। রাজ্য পুলিশে এখনও কর্মরত এক আধিকারিকের উদ্বেগ, ‘‘বাংলার জেলায় জেলায় এত বেআইনি অস্ত্র জমে রয়েছে যে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তা উদ্ধার করাও সোজা হবে না।’’
এগরার ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে, রাজ্যে এমন কাণ্ড এই প্রথম নয়। অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। আর তার অনেকগুলির ক্ষেত্রেই উঠেছিল বাজি কারখানার আড়ালে বোমা তৈরির অভিযোগ। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তার প্রমাণও পেয়েছিল রাজ্য পুলিশ। শুধু বোমাই নয়, ইদানীং কালে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় অস্ত্র তৈরি এবং মজুত রাখার খবরও এসেছে। বিরোধীদের দাবি, পঞ্চায়েত ভোটের জন্য রাজ্যে বোমা-অস্ত্রের মজুতদারি চলছে। শাসক ও প্রশাসনের ‘প্রশ্রয়েই’ দুষ্কৃতীরা সক্রিয় বলে বিরোধীদের অভিযোগ। অন্য দিকে, শাসক শিবিরের দাবি, অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্রাজ্যের লোকজন এসে বাংলায় এমন সব কারখানা চালায়। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্যও তাই।
গত মার্চেই অস্ত্র কারখানার হদিস মিলেছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ের হাটপুকুরিয়া অঞ্চলে। অস্ত্র কারখানা চালানোর অভিযোগে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র-সহ ধরা পড়েন বালুইঝাকা গ্রামের বাসিন্দা হৃষীকেশ মণ্ডল। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই নাকি বেআইনি অস্ত্রের কারবার চালাচ্ছিলেন বছর আশির হৃষীকেশ। তার আগে ওই জেলারই কুলতলিতে বেআইনি অস্ত্র কারখানার হদিস মেলে। সুন্দরবনে নদীর ধারে মাটির দেওয়াল এবং টিনের ছাউনি দেওয়া একটি বাড়ি থেকে প্রচুর অস্ত্র-সহ কারখানার মালিক মহিউদ্দিন সর্দারকে গ্রেফতার করে বারুইপুর থানার পুলিশ। সেই বারুইপুরের জীবনতলাতেই অতীতে অস্ত্র কারখানার হদিস পেতে পুলিশ মালিক রাজকুমার হালদারকে গ্রেফতার করে। একই রকম ভাবে মালদহের বৈষ্ণবনগর গ্রামের একটি লিচুবাগানে অস্ত্র কারখানার খোঁজ মেলে। ওই জেলারই কালিয়াচকে করারিচাঁদপুর পাটুয়াটুলি গ্রামে মাটির তলায় মেলে অস্ত্রের কারখানা। দুই জায়গাতেই অস্ত্র তো বটেই, সঙ্গে অস্ত্র তৈরির যন্ত্রপাতিও ছিল।
কলকাতার অদূরে হাওড়া জেলার টিকিয়াপাড়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে বড় আকারের বেআইনি অস্ত্র কারবারের খোঁজ পায়। হাওড়ার এক কারবারিকে ধরা হয় অস্ত্র ছাড়াও জালনোট ছাপার জন্য। জানা যায়, মুঙ্গের থেকে লোকজন এনে মধ্য কলকাতার স্ট্র্যান্ড রোডে শুল্ক দফতরের কাছেই চলছিল ওই কারবার। প্রচুর দেশি অস্ত্র, জাল নোট-সহ বড় পরিমাণে কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি উদ্ধার করে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। গত কয়েক বছরে এমন উদাহরণ অনেক। অস্ত্র কারখানার হদিস এমনকি, খাস কলকাতাতেও মিলেছে।
গত এক বছরের মধ্যে বার বার শিরোনামে এসেছে কালিয়াচকের পুকুরে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার, হাড়োয়ায় খড়ের বস্তায় লুকানো কার্বাইন উদ্ধার বা চাঁচলে কাঠের কারখানায় অস্ত্র তৈরির খবর। বীরভূমের বগটুইয়ের ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা নির্দেশ দিয়েছিলেন, রাজ্যে যেখানে যত বেআইনি অস্ত্র এবং বোমা রয়েছে, অবিলম্বে তল্লাশি চালিয়ে তার সব বাজেয়াপ্ত করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘যে পুলিশ ফুর্তি করবে, তাদের থাকার দরকার নেই। কয়েক জন পুলিশের জন্য গোটা ডিপার্টমেন্টের বদনাম হবে! এটা আমি বরদাস্ত করব না।’’ মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা কড়া বার্তা দেওয়ার পরেই গোটা রাজ্য জুড়ে সক্রিয় হয় পুলিশ। কয়েক দিনের মধ্যেই উত্তরবঙ্গের মালদহ থেকে দক্ষিণের নদিয়া, হাওড়া, বর্ধমান এবং দুই ২৪ পরগনায় পুলিশি অভিযানে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার হয়। হদিস মেলে অনেক অস্ত্র কারখানার।
রাজ্যে যে এটা নতুন নয়, তা মানছেন প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন। এক বার বারুইপুরে প্রশাসনিক কাজে গিয়ে তিনি একটি বাজি তৈরির কারখানার আড়ালে বোমার কারখানায় বিস্ফোরণের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অর্ধেন্দুর কথায়, ‘‘একটা সময়ে বেআইনি অস্ত্রের জন্য বিহারের মুঙ্গেরের নাম ছিল। এখন বাংলাতেও মুঙ্গেরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলা মুঙ্গের হয়ে গিয়েছে বলা না গেলেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে।’’ ভোটের আগে, বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে যে অস্ত্রের রমরমা বাড়ে, তা-ও মেনে নিয়ে রাজ্যের এই প্রাক্তন শীর্ষ আমলা বলেন, ‘‘এই সময়ে চাহিদা বাড়ে। ফলে জোগানও বাড়ে।’’
এটা যে রাজ্য পুলিশের অজানা তা নয়। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘অতীতের মতো এ বারেও পঞ্চায়েত ভোটের আগে অস্ত্রের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকেও যথেষ্ট বরাত পায় রাজ্যের দুষ্কৃতীরা। তাই রাজ্যের জায়গায় জায়গায় কারখানা খুলে অবৈধ অস্ত্র তৈরি করছে মুঙ্গেরের কারিগররা। তাদের মাথায় হাত রয়েছে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতার।’’ তাঁর আরও দাবি, বাজি কারখানার আড়ালে বোমা বাঁধার কাজ তো চলেই, সঙ্গে খাস কলকাতাতেও কয়েকটি ঘিঞ্জি বসতি এলাকায় সেভেন এমএম, নাইন এমএম পিস্তল এবং ওয়ান শটার তৈরি হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতেও একই ছবি। ওই পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘কোথায় কারা অস্ত্র বানাচ্ছে, কোথায় বিক্রি হচ্ছে, কারা কিনছে, সব যে পুলিশের অজানা তা নয়। কিন্তু পরিমাণ এতটাই বেশি এবং জাল এত বিস্তৃত, যে সবটার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়।’’
তবে রাজ্যের প্রাক্তন ডিআইজি পঙ্কজ দত্ত বেশি চিন্তিত এগরার ঘটনা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘‘এই জেলার ভূপতিনগরে কিছু দিন আগেই বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছিল। মৃত্যুও হয়েছিল। এর পরে পুলিশের যা করণীয়, তা করা হয়নি। ফলে এই ঘটনায় পুলিশকেও আক্রান্ত হতে হয়েছে। দিন দিন পুলিশের উপর আস্থা কমছে জনসাধারণের। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এই ঘটনা রাজ্যের জন্য এক অশুভ ইঙ্গিত।’’