TMC

‘সুরক্ষা কবচে’ রক্ষা নেই! ক্ষোভের মুখে একাধিক ‘দিদির দূত’, কারণ খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন

বুধবার থেকে শুরু হয়েছে তৃণমূলের ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি। গ্রামে, শহরে জনতার কাছে যাচ্ছেন দলের নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু মাত্র তিন দিনে সাতটি জায়গায় ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের! কেন?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:২১
Share:

কলকাতার নজরুল মঞ্চে ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি ঘোষণার দিনে। — ফাইল চিত্র।

বুধবার রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষকে দিয়ে শুরু। বৃহস্পতিবার রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। শুক্রবার সাংসদ শতাব্দী রায়, অর্জুন সিংহ, তারকা নেত্রী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং যুবনেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য। শাসক তৃণমূলের একের পর এক নেতা-নেত্রী সাধারণ মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়ছেন দলীয় জনসংযোগ কর্মসূচিতে গিয়ে। ঘটনাপ্রবাহ যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে এই ক্ষোভ কমে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম। বরং কর্মসূচি যত চলবে, এমন ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে— এমনই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে শাসক শিবিরের অন্দরে।

Advertisement

কেন এত ক্ষোভ? তৃণমূলের মধ্যেই দু’রকম মত। কেউ বলছেন, এটা খারাপ সঙ্কেত। এক বার শুরু হলে তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে দল। বস্তুত, ওই কর্মসূচির সফল রূপায়ণ আদৌ করা যাবে কি না বা ক্ষোভের আগুনে কর্মসূচিটিই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে শাসকদলের ভিতরে। তবে পাশাপাশিই দলের অনেক নেতা মনে করছেন, এটা আদতে ভাল লক্ষণ। প্রথমত, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৃণমূল স্তরের মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দলকে ভুল শুধরে নিতে সাহায্য করবে। কোথায় কোথায় উন্নয়নের খামতি রয়েছে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেলে সমাধানের রাস্তা পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, যে সব নেতা-নেত্রী এত দিন ‘নিরাপদ’ দূরত্বে বসে জনতার উপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন, ভোটে জেতার পর আর এলাকায় বিশেষ যাননি, তাঁদেরও পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা হবে। তৃতীয়ত, এর মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাজকর্ম সম্পর্কে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি সম্যক উপলব্ধি হবে। চতুর্থত, জনপ্রতিনিধিরাও অনুবীক্ষণের তলায় থাকবেন।

কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও ঠিক যে, দলের শীর্ষ স্তরের অধিকাংশ নেতা বা মন্ত্রীই বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে সরাসরি কোনও মন্তব্যে নারাজ। কেউ এর জবাব দিতে গিয়ে তুলে আনছেন গঙ্গাসাগর মেলা সফল ভাবে আয়োজনের তুলনা। কেউ বলছেন, ‘‘কোনও মন্তব্য করব না।’’ এমনকি, তিনি মন্তব্য করতে চাইছেন না, সেটিও লিখতে বারণ করছেন! যা থেকে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, কর্মসূচির শুরুতেই খানিকটা হোঁচট খাওয়া শুরু হয়েছে। তবে দলের ‘আশাবাদী’ অংশ বলছেন, যে কোনও কর্মসূচিরই প্রথম দিকটা খানিক নড়বড়ে হয়। আস্তে আস্তে বিষয়টি নিয়ে উভয় তরফই ধাতস্থ হয়। ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’-এর ক্ষেত্রেও তেমনই হবে। এখনই শঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি।

Advertisement

আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটকে সামনে রেখে সম্প্রতি জনসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ২ জানুয়ারি নজরুল মঞ্চ থেকে ওই কর্মসূচি ঘোষণার সময়ে হাজির ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সেখানেই ঘোষণা করা হয়, ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচির অন্তর্গত তৃণমূলের সাড়ে তিন লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক রাজ্যের প্রতিটি মানুষের বাড়িতে যাবেন। তাঁদের বলা হবে ‘দিদির দূত’। এই কর্মসূচিতে রাজ্য থেকে জেলার নেতা, সাংসদ, বিধায়কদেরও যোগ দেওয়ার কথা। শহরে এবং গ্রামে গিয়ে তাঁরা কথা বলবেন মানুষের সঙ্গে। জানাবেন সরকারি প্রকল্পের খুঁটিনাটি। কর্মসূচি চলবে দু’মাস। শুরু ১১ জানুয়ারি, বুধবার।

সেই বুধবারেই পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় গিয়েছিলেন কুণাল। গোবিন্দনগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় গিয়ে তিনি দলীয় কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। সেটা ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে ক্ষোভ। পুরনো কর্মীরা ইদানীং দলে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ শুনতে হয় কুণালকে। এর পর ধনঞ্জয়পুর গ্রামেও কুণালকে দেখে কাঁচা রাস্তা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এমনকি, কাজ না হলে ভোট বয়কটের হুঁশিয়ারিও শোনা যায়। বৃহস্পতিবারও পাঁশকুড়ায় ছিলেন কুণাল। দলের একটি বৈঠকেও যোগ দেন। সেখানেও দু’টি রাস্তা কেন ঢালাই হয়নি, তা নিয়ে বচসা শুরু হয় দলেরই দুই নেতার মধ্যে! সেই ক্ষোভ সামাল দিতে হয় কুণালকে।

বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল যে, নদিয়ার চাকদহে গ্রামবাসীর বিক্ষোভের মুখে হাতজোড় করে ক্ষমা চান রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। সহিসপুর এলাকায় পঞ্চায়েতের কাজকর্ম নিয়ে নানা অভিযোগ শুনে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন জ্যোতিপ্রিয়। পরে তিনি হাতজোড় করে ক্ষমা চান এবং ত্রুটি শুধরে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে মন্ত্রী বলেন, “আমার দলের কোনও কর্মীর ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে আমি কুণ্ঠিত বোধ করি না।”

মন্ত্রী প্রকাশ্য ক্ষমাপ্রার্থনার কোনও ‘ইতিবাচক’ অভিঘাত অবশ্য রাজ্যের অন্যত্র পড়েনি। কারণ, শুক্রবার পর পর চারটি ঘটনা ঘটেছে। বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া তিন জেলায় ‘দিদির দূত’ হয়ে গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়েন শতাব্দী, দেবাংশু, অর্জুন, সায়ন্তিকা। নিজের লোকসভা বীরভূমের হাসন বিধানসভা এলাকায় যান শতাব্দী। সেখানে পৌঁছতেই দফায় দফায় বিক্ষোভে পড়েন অভিনেত্রী-সাংসদ। স্থানীয়েরা দাবি তোলেন, দিনের পর দিন কেটে গেলেও রাস্তা তৈরি হয়নি। একাধিক বার রাস্তা তৈরির প্রতিশ্রুতির দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। সাংসদকে সামনে পেয়ে আবাস যোজনার বাড়ি থেকে বার্ধক্য ভাতা-সহ নানা বিষয়ে অভিযোগ শোনাতে থাকেন গ্রামের মানুষেরা। তবে কোনও উত্তেজনা তৈরি হয়নি। মন দিয়ে সবার কথা শুনতে দেখা যায় শতাব্দীকে। শুক্রবার বীরভূমেরই বালিডুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের কুখুটিয়া গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ সামলাতে হয় তৃণমূলের যুব নেতা দেবাংশুকে।

খাতায়কলমে বারাকপুরের বিজেপি সাংসদ হলেও অর্জুন এখন তাঁর পুরনো দল তৃণমূলে। দলের কর্মসূচিতে শুক্রবার গিয়েছিলেন পুরুলিয়ায়। রঘুনাথপুরের জোরাডি গ্রামে ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। অনেকেই নানা অভাব-অভিযোগের কথা বলতে থাকেন। সেখানেও আবাস যোজনার কথা ওঠে। সেই সঙ্গে পানীয় জলের সংস্যা নিয়েও অনেকে সরব হন। কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করে নিজের গাড়িতে উঠে পড়েন পুরুলিয়ায় ‘দিদির দূত’ অর্জুন।

‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ নিয়ে প্রচারে বাঁকুড়ার জুনবেদিয়া গ্রামে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী সায়ন্তিকা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাঁকুড়া পুরসভার চেয়ারম্যান অলকা সেন মজুমদার ও তালড্যাংরার তৃণমূল বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তী। সকলকে হাতের কাছে পেয়ে এলাকার মহিলারা বিক্ষোভ শুরু করেন। মূলত পঞ্চায়েত স্তরের পরিষেবা নিয়েই অভিযোগ। সবটা শুনে সায়ন্তিকা শীঘ্রই স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

কর্মসূচি সবে তৃতীয় দিনে পা দিয়েছে। তার মধ্যেই সাতটি জায়গায় ক্ষোভ নিয়ে কিছুটা চিন্তা তো রয়েইছে শাসক শিবিরে। এর পরে নেতা-মন্ত্রীরা স্বচ্ছন্দে গ্রামে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়েও খানিকটা সংশয় তৈরি হয়েছে। এই ধরনের ক্ষোভকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক আক্রমণ আরও উস্কে দিতে পারেও বলেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তবে একে তৃণমূলের অনেকে ‘অশনি সঙ্কেত’ বলে দেখতে রাজি নন। এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘গত লোকসভা নির্বাচনের পরে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি নিয়েও এই ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া হয়েছিল। তখনও অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্ন ভাবে ক্ষোভের কথা শুনতে হয়েছিল। পরে দল এবং সরকার সে সব শুধরে নিতে পেরেছিল বলেই বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয় মিলেছে। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই।’’ দলের মুখপাত্র কুণালের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘মানুষের অভাব-অভিযোগ শোনার জন্যই তো এই কর্মসূচি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement