গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
তত দিনে জয়নগরে ন’বছরের শিশুকে নির্যাতন করে খুনের ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আরজি কর নিয়ে নাগরিক আন্দোলনের ক্ষোভের আগুনে যা খানিকটা ‘ঘৃতাহূতি’ দিয়েছিল বলে অনেকে মনে করেছিলেন। কিন্তু তখনও দেখা গিয়েছিল, কলকাতার নাগরিক মিছিলে যখন স্লোগান উঠছে ‘তোমার স্বর, আমার স্বর’, তখন তাল মিলিয়ে বড়জোর ৫ শতাংশ বলছেন, ‘জয়নগর টু আরজি কর’। বাকিদের মুখে সেই ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’! স্লোগানের ধ্বনির জোরই স্পষ্ট করে দিয়েছিল, আরজি করের সঙ্গে জয়নগরকে এক বন্ধনীতে ফেলার চেষ্টা হলেও তা সফল হচ্ছে না। আরজি কর যে ‘অভিঘাত’ তৈরি করেছে, জয়নগর তা পারছে না। আরজি কর-কাণ্ডের ৭০ দিন পরেও আন্দোলন রয়ে গিয়েছে। কিন্তু আরজি কর থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরত্বের জয়নগর জনতার স্মৃতিতে প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে অন্য পাঁচটা ঘটনার মতো।
শনিবার জয়নগরের কৃপাখালি গ্রামে শিশুকন্যাকে নির্যাতন এবং খুনের ঘটনার প্রতিবাদে কয়েক হাজার মানুষের সভা হয়েছে। যে সভা হয়েছে নাগরিক সমাজের নামে। কিন্তু নেপথ্যে ছিলেন সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়দের মতো রাজনীতির মানুষ। তবে কান্তিও মানছেন, আরজি কর যে ভাবে ‘আলোড়ন’ তৈরি করতে পেরেছে, জয়নগর তা পারেনি। কেন পারেনি, তা নিয়ে নানা জনের নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে কান্তির মতোই বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল থেকে কংগ্রেস নেতা সুমন রায়চৌধুরীরা একবাক্যে মানছেন, আরজি কর কলকাতার ঘটনা বলেই এত আলোড়ন। জয়নগরের কৃপাখালি প্রান্তিক এলাকা। তাই ‘প্রত্যাশিত’ আলোড়ন তৈরি করতে পারেনি। জয়নগর নিয়ে যাঁরা আন্দোলন সংগঠিত করতে নেমেছিলেন, তাঁরা ঘনিষ্ঠদের কাছে আক্ষেপও করেছেন এ নিয়ে।
এর নেপথ্যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক— দুই প্রেক্ষাপটই রয়েছে বলে মত অনেকের। যেমন সিপিএম নেতা কান্তি মনে করেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে বৈষম্য রয়েছে, এটা তারই ফল। প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তির কথায়, ‘‘কলকাতার যে কোনও ঘটনায় সংবাদমাধ্যম যেমন উদ্বেলিত হয়, জেলার ক্ষেত্রে হয় না। এর কারণ স্থানমাহাত্ম্য। এই দোষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলিও মুক্ত নয়। তবে এ-ও ঠিক যে, এই ত্রুটি আমাদের সকলকে মিলেই সংশোধন করতে হবে।’’
বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রাও মনে করেন, আরজি কর ‘কলকাতা কেন্দ্রিক’ ঘটনা বলেই এত আলোড়ন। যা জয়নগরের ক্ষেত্রে হয়নি। গত ৯ অগস্ট বিকালে আরজি কর হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন অগ্নিমিত্রা। জয়নগরের ঘটনাতেও পৌঁছেছিলেন তিনি। জয়নগরের গ্রামে দাঁড়িয়ে তৃণমূল সাংসদ প্রতিমা মণ্ডলের সঙ্গে বিতণ্ডাতে জড়িয়েছিলেন আসানসোল দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক। সেই তিনি এ-ও বলছেন, ‘‘একে তো আরজি কর কলকাতার ঘটনা। তদুপরি কর্মক্ষেত্রে ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করার পরে এক জন ডাক্তারকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। সেই বিষয়টা অনেক বেশি মানুষকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।’’ অগ্নিমিত্রা অবশ্য এ-ও মনে করেন যে, এক জন ডাক্তারকে যদি জেলাতেও ওই ভাবে অত্যাচার করে খুন করা হত, তা হলেও আলোড়িত হত সমাজ। কারণ, ডাক্তারদের মানুষ অন্য চোখে দেখেন।
কেন জয়নগর আলোড়ন তৈরি করতে পারল না? এই প্রশ্ন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। তিনি বলছেন, ‘‘হতে পারে শহরের আঙ্গিকে আমরা অনেকে আরজি করের নির্যাতিতার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছি। কিন্তু জয়নগরের ঘটনা আরও ভয়াবহ! কারণ, সেখানে নির্যাতিতা একটি শিশু।’’ অনুত্তমা মনে করেন, এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘ধারাবাহিকতার’ থেকে ‘সংহতি’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এ-ও বলেন, ‘‘আন্দোলনের ঘোড়ার পিঠ থেকে যেন মৌলিক বিষয়গুলি ছিটকে না যায়। আমরা যেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকি।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক জয়দীপ ঘোষ আবার বিষয়টিকে কলকাতা এবং জেলার ‘দূরত্ব’কেই মুখ্য বলে মনে করেন। তাঁর কথায়, ‘‘জেলায় বন্যা হলে যা না প্রচার হয়, কলকাতায় বৃষ্টিতে এক ঘণ্টা জল দাঁড়ালে আর অনেক বেশি অভিঘাত হয়। একই ভাবে জেলার পুজো-কলকাতার পুজো, জেলার থিয়েটার-কলকাতার থিয়েটার— সব ক্ষেত্রেই এই মনোভাবটা রয়েছে।’’
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা সুমন রায়চৌধুরী আরজি কর এবং জয়নগরের আন্দোলন প্রসঙ্গে কলকাতা ও জেলা ‘ফ্যাক্টর’ নিয়ে সহমত পোষণ করলেও ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আরজি কর কলকাতার হাসপাতাল। সেটা যেমন আন্দোলনের ঢেউ তোলার অন্যতম কারণ, তেমনই এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, এই ঘটনা গোটা স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দুর্বৃত্তায়নকে প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। সেটাও ভুলে গেলে চলবে না।’’
অক্টোবরের গোড়ায় জয়নগরের মহিষমারি এলাকায় একটি জলাভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় এক ন’বছরের শিশুর দেহ। অভিযোগ ছিল, তাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। রাতেই সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে অভিযুক্তকে চিহ্নিত করে পুলিশ। তাকে গ্রেফতারও করা হয়। তার পরেও ওই ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে ‘নিষ্ক্রিয়তার’ অভিযোগ তুলে পর দিন সকাল থেকে বিক্ষোভ দেখায় স্থানীয় জনতা। ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ফাঁড়িতে। আদালতের নির্দেশে সেই শিশুকন্যার দেহের ময়নাতদন্তে হয় কল্যাণী এমসে।
তার পর থেকে জয়নগর নিয়েও আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সে ভাবে রাস্তায় নামেনি ‘নাগরিক সমাজ’। আরজি কর আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা জুনিয়র ডাক্তারেরা জয়নগরের নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়েছেন। ধর্মতলার অনশনমঞ্চে ‘বিচার চায় জয়নগর’ বলে ফ্লেক্সও লাগানো হয়েছে। কিন্তু ‘নাগরিক আন্দোলন’ প্রমাণ করে দিয়েছে, জয়নগর আসলে অনেক দূরের গ্রহ!