হাওড়া পরিস্থিতির উপর ‘নজরদারি’ চালাতে রাজ্যপাল যে ‘বিশেষ সেল’ তৈরি করলেন, তাতে কারা রয়েছেন সে ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। ছবি: সংগৃহীত।
রামনবমীর মিছিল ঘিরে বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনা ঘটেছে হাওড়ার কিছু এলাকায়। অনভিপ্রেত সেই অশান্তি আপাতত মিটে গেলেও ওই ঘটনা নতুন এক অভিঘাত রেখে গিয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। অশান্তি শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস ওই বিষয়ে কোনও কথাই বলেননি। কিন্তু শুক্র-সন্ধ্যায় তিনটি ঘটনা জন্ম দেয় নতুন পরিস্থিতির।
প্রথম, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন রাজভবনে। অমিত শাহের সঙ্গে কথা হয় রাজ্যপাল আনন্দের। যা প্রশাসনিক পরিসরে স্বাভাবিক ঘটনা। কোনও রাজ্যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বা ওই দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কেন্দ্রের সাংবিধানিক প্রতিনিধি রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলতেই পারেন। দ্বিতীয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্যপালের ‘একান্ত’ আলোচনা। এতেও ‘নতুনত্ব’ কিছু নেই। প্রশাসনিক কাজের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মুখ্যমন্ত্রী-রাজ্যপাল যৌথ সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তৃতীয় ঘটনাটি তত ‘স্বাভাবিক’ নয়। তার আবার দু’টি অংশ। শুক্রবার রাজ্যপাল একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছেন, তিনি রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছে হাওড়ার পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তলব করেছেন। আর দ্বিতীয় অংশে জানিয়েছেন, প্রতি মুহূর্তের ঘটনা জানতে রাজভবনের তরফে ‘বিশেষ সেল’ খুলেছেন রাজ্যপাল। সেটিও বিবৃতি দিয়ে প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রশ্ন উঠেছে এই ‘বিশেষ সেল’ নিয়েই।
শাসক শিবিরের একটি অংশ একে ‘পৃথক প্রশাসন’ চালানোর ইঙ্গিত বলে ব্যাখ্যা করছে। তৃণমূলের প্রশ্ন, আদৌ কি এমন সেল গঠনের বৈধ ক্ষমতা রয়েছে রাজ্যপালের? দলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ শনিবার বলেন, ‘‘এই ভাবে বিশেষ সেল গঠনের কোনও বৈধ সংস্থান নেই আইনে। রাজ্যপাল তো রাজ্য প্রশাসনকে নিয়েই কাজ করেন। তবে তিনি যে সেল গঠন করেছেন সেটা মৌখিক, না কি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সেটা দেখতে হবে।’’ একই সঙ্গে কুণালের আশঙ্কা, ‘‘রাজ্যপাল সংবাদমাধ্যম বা অন্য কোনও বেসরকারি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। সেটা যদি হয় তবে সেই রিপোর্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে।’’
যার পাল্টা রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল তথা কেন্দ্রের শাসক বিজেপি বলছে, রাজ্যের সব মানুষের মানবাধিকার রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, তিনি এমন উদ্যোগ নিতেই পারেন। তৃণমূলের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘রাজ্যপাল সংবিধানের রক্ষাকর্তা। মানুষের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারগুলি রক্ষা করা হচ্ছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব রাজ্যপালের। তিনি প্রয়োজনে বিশেষ সেল গঠন করতে পারেন। নিজে অকুস্থলে চলে যেতে পারেন। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে রিপোর্টও তলব করতে পারেন।’’
শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজভবনের দেওয়া লিখিত বিবৃতি। ছবি: সংগৃহীত।
রাজ্য প্রশাসনের একটি অংশের আবার জল্পনা, শাহের নির্দেশেই কি রাজ্যপাল রাজ্য প্রশাসনে নতুন রুট তৈরির বিষয়ে উদ্যোগী হলেন? এ রাজ্যে তো বটেই, দেশের অন্যত্রও সাম্প্রতিক কালে এমন নজির রয়েছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। বাংলায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো ‘উত্তাল’ সময়েও রাজভবনের তরফ সকলকে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে এমন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। ‘কড়া’ রাজ্যপাল হিসাবে পরিচিত বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সময়েও রাজ্যে অনেক সময় বিভিন্ন এলাকায় অনভিপ্রেত সংঘাতের ঘটনা দেখা গিয়েছে। বার বার ‘অতিতৎপর’ অভিযোগে অভিযুক্ত ধনখড় বিভিন্ন সময়ে কড়া ভাষায় নবান্নের সমালোচনা করেছেন, আইনজীবী হিসাবে কখনও আইনের ধারাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোনও বিশেষ এলাকার জন্য ‘বিশেষ সেল’ গঠন করেননি। যা করেছেন প্রাক্তন আইএএস আনন্দ বোস।
হাওড়া পরিস্থিতির উপর ‘নজরদারি’ চালাতে রাজ্যপাল যে ‘বিশেষ সেল’ তৈরি করলেন, তাতে কারা রয়েছেন, সে প্রশ্নও তুলছে শাসক শিবির। রাজভবনের তরফে এই ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু জানানো হয়নি। তৃণমূলের একাংশের প্রশ্ন, প্রথামাফিক রাজ্য প্রশাসনের রিপোর্টের উপরে ভরসা না রেখে রাজ্যপাল কি নিজের ‘ভরসা এবং আস্থা’র পাত্রদের এই কাজে নিয়োজিত করেছেন?
বাংলায় দায়িত্ব পাওয়ার পরে নবান্নের সঙ্গে মধুর সম্পর্কই দেখিয়েছিলেন রাজ্যপাল আনন্দ। যেটাকে ‘দহরম মহরম’ বলে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিজেপি। রাজ্যপালের বিভিন্ন কাজ নিয়ে সরাসরি প্রকাশ্য সমালোচনা করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। রাজভবন এবং বিজেপির মধ্যে সেই দূরত্বের সময়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। রাজভবন থেকে বেরিয়ে সুকান্ত বলেছিলেন, ‘‘সকলের কাজ করার ভঙ্গি একই রকম হয় না।’’ তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আনন্দ-পদক্ষেপের ‘ব্যতিক্রমী’ ভঙ্গি নজরে আসে। সে দিনেই রাজভবনের তরফে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কড়া বিবৃতি দেওয়া হয়। তার কয়েক দিনের মধ্যে ‘অপছন্দ’ জানিয়ে রাজভবনের প্রধান সচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় নন্দিনী চক্রবর্তীকে। সেটাই শুরু রাজভবনের সঙ্গে নবান্নের সম্পর্কের ‘অবনতি’র।
প্রসঙ্গত, নন্দিনীর জায়গায় এখনও কোনও প্রধান সচিব নেই রাজভবনে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, নবান্ন তিনটি নামের তালিকা পাঠালেও তা নাকচ করে দিয়েছেন রাজ্যপাল। আর রাজভবনের একটি অসমর্থিত সূত্রের খবর, ভিন্রাজ্যের কয়েক জন প্রাক্তন আইএএসকে নিয়ে নিজের ‘টিম’ বানিয়ে নিয়েছেন আনন্দ। রাজ্যপাল নতুন প্রধান সচিব নেবেন কি না জানতে চাওয়ায় রাজ্যপালের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত এক বিজেপি নেতা বলেন, ‘‘উনি নিজে বড় বড় প্রশাসনিক পদে কাজ করে এসেছেন। সুতরাং সরকারি ফাইল দেখার কাজ উনি একলা সামলাতেও যথেষ্ট দক্ষ।’’
এই সংঘাতের আবহেই রাজ্যপাল নির্দিষ্ট করে একটি এলাকায় নজরদারির জন্য ‘বিশেষ সেল’ গঠন করেছেন। যা রাজ্য প্রশাসনের উপর ‘অনাস্থা’রই নামান্তর। এবং সেটি তিনি করেছেন সকলকে জানিয়েই। প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে। যা আরও বেনজির। রীতি এবং রেওয়াজ বলে, রাজ্যপালকে যে হেতু রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি মাসেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে রিপোর্ট পাঠাতে হয়, তাই রাজভবন সব সময়েই রাজ্য প্রশাসনের পাশাপাশিই বিভিন্ন ‘সূত্র’ থেকে রসদ সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু তা কখনও জনসমক্ষে আনা হয় না। ঘোষিত ভাবে এই ‘বিশেষ সেল’ গঠন করা সেই দিক থেকেও ‘ব্যতিক্রমী’ পদক্ষেপ। অনেকে বলছেন, এটি আসলে নবান্নের উপর ‘চাপ’ তৈরির জন্য। যে, রাজ্য প্রশাসনের পাশাপাশি রাজভবনেরও ‘সমান্তরাল চোখ এবং কান’ রইল। আবার অনেকের মতে, নবান্নের একেবারে অগোচরে রাজভবন ওই ‘বিশেষ সেল’ খোলেনি। এখন দেখার, ওই সেলের রিপোর্ট রাজ্য প্রশাসনের থেকে আলাদা হয় কি না। হলেও কতটা।