গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
সীতাঠাকুরের তিন কন্যে। এক কন্যে পড়ান-শোনান, এক কন্যে এমফিল করেন, এক কন্যে রাজনীতি।
বালিতে দীপ্সিতা ধর, জামুড়িয়ায় ঐশী ঘোষ এবং নন্দীগ্রামে মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বামেদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হতেই সিপিএমের তিন কন্যাকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল রাজ্য রাজনীতিতে। বাম শিবির থেকেও বলা হয়েছিল, দল ‘ইউথ আইকন’, যুববিগ্রহ পেয়েছে। কিন্তু তিন কন্যা ভোটে জেতেননি।
মীনাক্ষী রাজ্য রাজনীতিতে আন্দোলনে থেকে গেলেও দীপ্সিতা, ঐশী ফিরে গিয়েছেন লেখাপড়ার জগতে। দু’জনেই আপাতত দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
তবে এসএফআই-এর সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক দীপ্সিতার দাবি, তিনি ভোটের পরেও নিজের এলাকায় কাজ করেছেন। কর্মীদের সঙ্গে ছিলেন। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির সময় রেড ভলান্টিয়ার্সের কাজও দেখেছেন। তবে জেএনইউয়ের ভূগোলের ছাত্রী এখন পিএইচডি নিয়ে ব্যস্ত। তারই ফাঁকে তিনি বালিতে আসতে চান জুলাইয়েই। দিল্লি থেকে দীপ্সিতা বললেন, ‘‘আমাদের তো নির্বাচন অনুযায়ী সাংগঠনিক দায়িত্ব হয় না। আমি যখন প্রার্থী হয়েছিলাম, তখন সেখানকার গণসংগঠনের দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাই সবটা করেছিলেন। তাঁদের পরামর্শেই আমি কাজ করেছি। আর ছাত্র সংগঠনের সর্বভারতীয় দায়িত্ব তো বাংলা বা দেশে আমি পালন করছিই। প্রার্থী করা হয়েছিল বলেই সেখানে গিয়ে আমি নেতৃত্বকে কোনও নির্দেশ দেব, সেটা তো আমাদের দলে হয় না। তবে যেতে ইচ্ছা করে। জুলাইয়েই বাংলায় ফিরব। বালিতেও যাব।’’
একই সুর ঐশীর গলাতেও। সদ্য এমফিল পেপার জমা দিয়েছেন জেএনইউয়ের ছাত্রী ঐশী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও মাঝেমাঝে তাঁরও জামুড়িয়া যেতে ইচ্ছে করে। বলেন, ‘‘জামুড়িয়ায় লড়াইয়ের পর বেশ কিছুদিন রেড ভলান্টিয়ার হিসাবেও কাজ করেছি ওখানে। তার পরে গবেষণার জন্য দিল্লি চলে আসতে হয়। এটা ঠিক যে, সেখানে গিয়ে সকলের সঙ্গে কাজ করতে পারছি না। তবে যত বার বাড়ি গিয়েছি, তত বারই জামুড়িয়ায় গিয়ে থাকার চেষ্টা করেছি। ফোনে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সেখানকার মানুষের ভালবাসা মিস করি।’’
তবে কমরেডরা ফোন করলে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে ঐশীর। দরকারে পরামর্শও দেন। কিন্তু দূরত্বের ফলে একটা শূন্যস্থানও তৈরি হয়। ঐশীর কথায়, ‘‘ওখানে কাজ করার সময়ে যে পরিবারের মতো তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সেটা অবশ্যই মিস করি। তাই ভাবছি, লেখাপড়া দ্রুত শেষ করে ওখানে যাব। যেখানে কাজটা ছেড়ে এসেছিলাম, সেখান থেকে যেন শুরু করতে পারি।’’
ভাষণ দিচ্ছেন ঐশী ঘোষ।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অবশ্য জানাচ্ছেন, ‘মিশন ৩৬০ ডিগ্রি’-র লক্ষ্যেই কাজ করছেন ওঁরা। সেলিমের কথায়, ‘‘সকলেই যে একই কাজ করবেন, তা তো নয়! আমরা স্টাডি অ্যান্ড স্ট্রাগলের কথা বলি। তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী। কেউ গান বাঁধছেন, কেউ নাটক করছেন, কেউ ক্যান্টিন চালাচ্ছেন, কেউ রেড ভলান্টিয়ার্সের কাজ করছেন। ঐশী, দীপ্সিতারা লেখাপড়া করছেন। সেটাও তো প্রয়োজনীয়। এটা আমাদের ‘মিশন ৩৬০ ডিগ্রি’ নীতি। সকলকে নিয়ে সমাজের সব ক্ষেত্রে আমাদের এই নীতিগত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’’
বালিতে ভোটে জিততে পারেননি। কিন্তু দীপ্সিতাকে নিয়ে কর্মী-সমর্থকেরা ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন। ঐশীকে নিয়েও জামুড়িয়ায় আবেগে ভেসেছিলেন স্থানীয় নেতৃত্ব। কিন্তু ভোটের পরে তাঁদের সে সব কেন্দ্রে সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না।
দীপ্সিতা-ঐশীর হস্টেল কাছাকাছি। ফলে যোগাযোগ নিয়মিত। ঐশী জানালেন, দিল্লিতে এসএফআই-এর কাজে দু’জনেই রয়েছেন। তাঁরা কি বাংলায় সিপিএমকে আবার চাঙ্গা করার কাজে লাগবেন?
ঐশীর জবাব, ‘‘আমার মনে হয় নতুন-পুরনো সকলে মিলে কাজ করতে হবে। আগেও আমাদের একই পরিকল্পনা ছিল। ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৃণমূলই বিকল্প, বামপন্থা নয়— এমন ধারণা ভাঙতে হলে আমাদের সবাইকে মিলে শুধু ভোটে দাঁড়িয়ে নয়, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হবে। মানুষের প্রতি দিনের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হবে।’’
ঐশী আরও বোঝান, নিজেদের লেখাপড়া শুধুই ব্যক্তিগত কেরিয়ারের জন্য নয়। বলেন, ‘‘আমাদের পড়াশোনা ব্যক্তিগত ডিগ্রির জন্য নয়। এই পড়াশোনা সমাজকে প্রগতিশীল দৃষ্টিতে দেখার ধরন তৈরির একটা প্রশিক্ষণ। এটাও বোঝাতে চাই যে, পড়াশোনা করাটা সকলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। লেখাপড়া থেকে আমরা শিখি, যা শিখলাম, তা যেন সমাজকে ফেরত দিতে পারি। খুব তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শেষ করে তাই মানুষের মধ্যে থেকে কাজ করতে চাই।’’
দীপ্সিতা ধর, বৃন্দা কারাত এবং মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়।
সীতাঠাকুরের (জগৎ যাঁকে চেনে সীতারাম ইয়েচুরি বলে। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক) তিন কন্যে একই সুরে বাঁধা। ভোটের সময় অবশ্য মীনাক্ষী সবচেয়ে বেশি ‘আলোকিত’ ছিলেন। কারণ, নন্দীগ্রামে তাঁর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভোট-পরবর্তী সময়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
হেরে গেলেও ঐশী-দীপ্সিতার তুলনায় অনেক বেশি রাজনীতিতে রয়েছেন মীনাক্ষী। আন্দোলনে রয়েছেন। সম্প্রতি সিপিএমের রাজ্য কমিটিতেও জায়গা পেয়েছেন। ‘আনিস-হত্যা’র প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেলেও ছিলেন তিনি।
তবে ঐশী-দীপ্সিতাদের লেখাপড়ার সিদ্ধান্তের পাশে রয়েছেন মীনাক্ষী। পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ভাষায় যুক্তি সাজিয়ে তিনি বললেন, ‘‘দেশের নিয়মনীতির বাইরে তো রাজ্য নয়। আমরা যারা বামপন্থী রাজনীতি করি, তাদের লড়াই নীতির বিরুদ্ধে। সেই নীতিতে তো দু’টো সরকারই একরকম ভাবে সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী কাজ করছে। আমরা যে যেখানেই রয়েছি, সেই নীতির বিরুদ্ধেই লড়ছি।’’ যোগ করেন, ‘‘ওরা জেএনইউতে পড়ছে। ওরা ওখানে নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমরা এখানে লড়ছি। ছাত্র রাজনীতিতে যে যেখানে পড়বে, সেখানেই তো কাজ করবে!’’
বলেন, ঐশী-দীপ্সিতা দু’জনেই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আছেন। মীনাক্ষীর কথায়, ‘‘অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে যেদিন ছাত্র-যুব সংগঠন পথে নামল, সেদিনও ঐশী গ্রেফতার হয়েছে। রাত্রি সওয়া ১টার সময় ওকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে হয়েছে। দীপ্সিতাকে এখনও এই হস্টেল থেকে ওই হস্টেল তাড়া করছে। বই, খাতাপত্র নিয়ে মেয়েটা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় দৌড়াচ্ছে।’’
মীনাক্ষী-ঐশী-দীপ্সিতার মতো তরুণ মুখ সায়নদীপ মিত্রকেও সিপিএম প্রার্থী করেছিল কামারহাটি আসনে। তিনিও মনে করেন, ঐশী-দীপ্সিতাদের লেখাপড়া শেষ করাটা বেশি জরুরি। বলেন, ‘‘ওদের দিল্লিনির্ভর লেখাপড়া। সেটার সঙ্গে আপস করে কী করে এখানকার কাজে মনোনিবেশ করবে।’’
একই দাবি সেলিমেরও। তবে তিনি শুধু ঐশী-দীপ্সিতা-মীনাক্ষীদের নিয়ে আলোচনায় রাজি নন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের কথায়, ‘‘যারা ভোটে দাঁড়িয়েছিল, তাদের নিয়েই সংবাদমাধ্যমে বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু দলে নতুন প্রজন্মের অনেকেই ভাল কাজ করছে। গ্রামেগঞ্জে নানা বাধা, প্রতিকূলতার মধ্যেও কাজ করে চলেছে। আর এ কাজটা নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছর ধরেই তরুণদের মধ্য থেকে যোগ্যদের খুঁজে নেতৃত্ব তৈরির কাজ চলছে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এটার মাল্টিপ্লাই এফেক্ট হবে।’’ সকলকে নিয়ে কাজ করাই সিপিএমের নতুন রাজ্য সম্পাদকের ‘মিশন ৩৬০ ডিগ্রি’ পরিকল্পনা। যাতে সীতাঠাকুরও খুশি হন।