বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনে শুভেন্দু অধিকারী। — নিজস্ব চিত্র।
গতবছর ২০ জুন ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল রাজভবন-নবান্ন। কিন্তু এই বছর রাজভবনে সেই দিনটিই পালিত হল কার্যত নমো-নমো করে। এতটাই যে, সেই কর্মসূচিতে স্বয়ং রাজ্যপালই হাজির রইলেন না। যদিও তিনি ছিলেন রাজভবনেই। তবে রাজ্য একটি ভিডিয়ো বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেটি রাজভবনে উপস্থিত কয়েকজনকে শোনানোও হয়েছে। রাজভবন সূত্রের খবর, ওই কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গানটি পরিবেশিত হয়। ঘটনাচক্রে, যে গানটিকে সহমতের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘রাজ্য সঙ্গীত’ হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন। পাশাপাশিই তিনি পয়লা বৈশাখকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ বলে ঘোষণা করেছিলেন।
বিজেপি বরাবর ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসাবে ২০ জুনকে ‘প্রাধান্য’ দিয়েছে। ২০২৩ সালে রাজ্য সরকারের সঙ্গে বিজেপির এ নিয়ে সংঘাত বেধেছিল। কিন্তু এ বছরে তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কলকাতায় মেয়ো রোডে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিতে মাল্যদান করেছেন। কয়েক জন বিধায়ককে নিয়ে তিনি বিধানসভায় শ্যামাপ্রসাদের প্রতিকৃতিতেও পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন। বিজেপি পরিষদীয় দল এমনটা করলেও রাজ্য বিজেপির পক্ষে তেমন কোনও কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। আর তা নিয়ে আক্ষেপের সঙ্গে দলের নেতা তথা রাজ্য কর্মসমিতির সদস্য মোহিত রায় বলেন, ‘‘এটা ঠিক হয়নি। এই দিনটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব মাথায় রেখে বড় কর্মসূচি নেওয়া উচিত ছিল।’’ প্রসঙ্গত, তাঁর উদ্যোগে প্রতিবারের মতো এ বারেও কলকাতার সন্তোষপুরে একটি অনুষ্ঠান হয়েছে।
বিজেপি দাবি করে, শ্যামাপ্রসাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই দিনে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করা উচিত। শ্যামাপ্রাসাদের নেতৃত্বেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুন আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের অংশ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে সিলমোহর পড়ে। বিজেপির দাবি, সে দিন ‘শ্যামাপ্রসাদপন্থী’ ৫৪ জন বিধায়কের দাবির কাছেই পশ্চিমবঙ্গ স্বীকৃতি পেয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদের দাবি ছিল, ভারত ভাগ করলে বাংলাকে ভাগ করে বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ তৈরি করতে হবে। যা হবে হিন্দুপ্রধান ভারতের অংশ। এ বিষয়ে প্রচার করার জন্য শ্যামাপ্রসাদ সারা বাংলা চষে বেড়ান এবং কংগ্রেসের সমর্থন পান বলেও দাবি বিজেপির। তাদের আরও দাবি, এর ফলেই পশ্চিমবঙ্গের জন্ম। প্রতি বছর রাজ্য বিজেপির পক্ষে এই দিনটিতে কোনও না কোনও কর্মসূচি হয়। তবে এ বারে শুভেন্দুর মাল্যদান ছাড়া কলকাতায় বিশেষ কিছু হয়নি।
কেন হল না, তারও একটি ‘ব্যাখ্যা’ মিলছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে বিজেপি দিনটি পালন করেছিল পরের বছরের লোকসভা নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রেখে। ওই নির্বাচনে হিন্দু ভোট ‘সংগঠিত’ করার লক্ষ্য ছিল পদ্মশিবিরের। কিন্তু এ বার তেমন কোনও ‘তাগিদ’ নেই। দুপুর পর্যন্ত রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার থেকে শুভেন্দু কেউই তাঁদের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে এই দিনটি নিয়ে কোনও পোস্ট করেননি। অন্য নেতারাও করেননি। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর আসনে বিজেপির প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর পরিচালক পদে রয়েছেন। তিনি অবশ্য এই দিনটি নিয়ে একটি পোস্ট করেছেন। জানিয়েছেন, নদিয়ায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা করবেন।
বাংলার রাজভবনে ২০ জুন ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন শুরু করেছিলেন প্রাক্তন রাজ্যপাল তথা বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। ২০২৩ সালে সেই পথেই হাঁটবেন বলে জানান বর্তমান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। তাতে আপত্তি তোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। রাজ্যপালকে চিঠি দিয়ে তিনি সেকথা জানান। ফোনও করেন। মুখ্যমন্ত্রী চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আপনার সঙ্গে আজ আমার ফোনে কথা হয়েছে। আপনি স্বীকার করেছেন যে, রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়া একতরফা কোনও একটি বিশেষ দিনকে রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দিবস বলে ঘোষণা করা ঠিক হয়নি। আপনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, আপনি ওই অনুষ্ঠান পালন করবেন না।’
তা সত্ত্বেও রাজ্যপালের উপস্থিতিতে রাজভবনে সাড়ম্বরে ওই কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। কিন্তু এ বার সেই রাজভবনের অনুষ্ঠানে স্বয়ং রাজ্যপালই গরহাজির রইলেন। বিজেপির উদ্বাস্তু শাখার প্রাক্তন প্রধান মোহিত বরাবরই এই দিনটি পালনে উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁরই উদ্যোগে বিজেপির রাজ্য দফতরের সামনেও কয়েক বার অনুষ্ঠান হয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনাক্রম দেখে মোহিত বলেন, ‘‘বিজেপির অনেকেরই পশ্চিমবঙ্গ দিবসের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে ধারণা কম। তবে শুভেন্দু অধিকারী যে রাজনীতি ভাল বোঝেন, তা বোঝা গিয়েছে প্রতি বছর এই দিন তাঁর উদ্যোগ দেখে। ২০২১ সালেই তিনি বিধানসভার সামনে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করেছিলেন। বিধানসভাতেও তিনি এই দিনটির গুরুত্ব আদায়ে সরব হয়েছেন। এ বার তিনি দলীয় পতাকা ছাড়া গিয়েছেন মেয়ো রোডে। বোঝা গিয়েছে, এক মাত্র তিনিই ভোলেননি এই দিনটিকে।’’ পাশাপাশিই মোহিত বলেন, ‘‘২১ জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালনে অনেক উদ্যোগ দলের। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ দিবস অবহেলিতই রইল!’’