ইটালিতে জি৭ বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশটির আপুলিয়া প্রদেশে গত ১৩ থেকে ১৫ জুন ওই বৈঠক হয়েছে।
জি৭ বৈঠকের এ বারের আয়োজক দেশ ছিল ইটালি। সেখানকার প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গে মোদীর নিজস্বী ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের সুসম্পর্ক নিয়ে চর্চাও চলছে সমাজমাধ্যমে।
ভারত কিন্তু জি৭-এর সদস্য দেশ নয়। আদৌ ওই বৈঠকে যোগ দেওয়ার মতো পূর্ণ সদস্যপদ নেই নয়াদিল্লির। মোদী ইটালিতে গিয়েছিলেন বৈঠকে আমন্ত্রিত দেশ হিসাবে।
জি৭-এর আমন্ত্রণমূলক সম্মেলনে আলোচনার বিষয় ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), শক্তি, আফ্রিকা এবং ভূমধ্যসাগর। মোদী ওই বৈঠকে জানান, ২০৭০ সালের মধ্যে শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ভারত কাজ শুরু করে দিয়েছে। পাশাপাশি আফ্রিকা-সহ দরিদ্র এবং অনুন্নত দেশগুলির হয়েও বৈঠকে সওয়াল করেন মোদী।
জি৭-এর পুরো কথা হল ‘গ্রুপ অফ সেভেন’। অর্থাৎ, সাতটি দেশের একটি সম্মিলিত উদ্যোগ এই জি৭। বছরে এক বার করে জি৭-এর সদস্য দেশগুলি মিলিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করে এবং আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে।
জি৭-এর সদস্য দেশ কারা? কেন সদস্য না হয়েও সেখানে ডাক পেল ভারত? এই বৈঠকে আমন্ত্রিত দেশ হিসাবে ভারতের যোগদানের তাৎপর্যই বা কোথায়? প্রশ্নগুলির উত্তর জানতে ফিরে দেখতে হবে জি৭-এর ইতিহাস।
ইটালি, ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন (ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড) এবং আমেরিকা হল জি৭-এর সদস্য। এদের বাৎসরিক সম্মেলনের জন্য নির্দিষ্ট কোনও সদর দফতর চিহ্নিত করা নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শহরে জি৭ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
প্রতি বছর এই সাত দেশের মধ্যে যে কোনও এক সদস্যের উপর বৈঠক আয়োজনের ভার পড়ে। সে বছর সেই দেশেরই কোনও শহরে বৈঠক হয়। ওই আয়োজক দেশই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় স্থির করে। এ বার সেই ভার ছিল ইটালির।
সত্তরের দশকের শুরুর দিকে আমেরিকা-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি খানিক নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। নেপথ্যে অন্যতম কারণ ছিল খনিজ তেলের সঙ্কট। সেই প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছিল জি৭।
আমেরিকা-সহ অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী দেশগুলি একটি সংগঠনের আওতায় এসে বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ব অর্থনীতির হাল ফেরাতে একজোট হয় তারা। তবে শুরুতেই সাতটি দেশ ছিল না।
১৯৭৩ সালে প্যারিসে একটি বৈঠককে জি৭-এর আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসাবে ধরা হয়। এর প্রথম বৈঠক হয় ১৯৭৫ সালে। প্রথম বৈঠকে জার্মানি, আমেরিকা, ব্রিটেন, ইটালি, ফ্রান্স এবং জাপান ছিল। পরের বছর যোগ দেয় কানাডা।
১৯৭৭ সালের জি৭ বৈঠকে যোগ দিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নও। তাদের সদস্য এখনও এই বৈঠকে উপস্থিত থাকে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আলাদা করে জি৭-এর সদস্য হয়নি।
১৯৯৮ সালে রাশিয়ার যোগাদানে জি৭ পরিণত হয় জি৮-এ। শক্তিশালী অর্থনীতি হিসাবে এই বৈঠকে তাদের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং ক্রিমিয়া দখলের পর জি৮ থেকে রাশিয়াকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
গত কয়েক বছর ধরে জি৭ নানা মহলে সমালোচনার শিকার হয়েছে। সদস্য দেশগুলির মিলিত জিডিপি হ্রাস পেয়েছে। একের পর এক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির সামনে। প্রশ্ন উঠেছে জি৭-এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে।
চিন, ভারতের মতো একাধিক দেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছরে শক্তিশালী হয়েছে। চিন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, তবে জি৭-এ তার জায়গা নেই। আগামী অর্থবর্ষের শুরুতেই ভারতের অর্থনীতি ছাপিয়ে যেতে চলেছে জাপানকে। কিন্তু জি৭ সীমাবদ্ধ সাতটি দেশের মধ্যেই।
জি৭-এর পরিসর বৃদ্ধি নিয়ে নানা সময়ে নানা আলোচনা হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু দেশের মধ্যেই কেন ক্ষমতা কুক্ষিগত, সেই প্রশ্ন উঠেছে। জি৭-এর সমান্তরালে ১৯৯৯ সালে গড়ে ওঠে জি২০।
জি২০-তে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ১৯টি দেশ। সেগুলি হল ভারত, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, ইটালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটেন এবং আমেরিকা।
বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানেও ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান অনেক বেশি কার্যকরী হয়ে উঠেছে। সেই কারণে সদস্য না হলেও জি৭-এ গুরুত্ব পেয়ে থাকে ভারত।
এই নিয়ে মোট ১১টি জি৭ বৈঠকে ডাক পেল ভারত। মোদী পর পর পাঁচ বার জি৭-এর বৈঠকে যোগ দিলেন। ভারতকে বাইরে রেখে আন্তর্জাতিক সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনা করা যাচ্ছে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।