Bakubur rahaman

বিপুল বিত্তে চর্চায় বাকিবুর

তদন্তে নেমে ইতিমধ্যেই ইডি বাকিবুরের বিভিন্ন ব্যবসার সন্ধান পেয়েছে। সূত্রের খবর, অন্তত পাঁচটি চালকল এবং আটাকল আছে তাঁর। হোটেল ব্যবসা আছে। তার মধ্যে একটি হোটেল কলকাতার চিনার পার্কে এবং অন্যটি বেঙ্গালুরুতে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা ও বারাসত শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:২৭
Share:

বাকিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উত্তর ২৪ পরগনা এবং নদিয়ার বহু চালকলে রীতিমতো রেশন দুর্নীতির ‘সিন্ডিকেট’ চলেছে বলে ইডি সূত্রে দাবি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির তদন্তকারীদের বক্তব্য, এই সিন্ডিকেটেরই অন্যতম চাঁই ধৃত ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমান, যাঁকে ইতিমধ্যেই রেশন দুর্নীতিতে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Advertisement

এ-ও অভিযোগ উঠেছে যে, মূলত কম দামে ন্যায্য মূল্যের ধান কিনে তা বেশি দামে সরকারকে বিক্রি করতেন বাকিবুর। বহু সময়ে ভিন্‌ রাজ্য থেকে নিম্নমানের চাল এনে তা সরকারকে গছিয়ে দিতেন এবং এ রাজ্যের চাষিদের ধান থেকে ভাঙানো চাল সরকারের ঘরে পাঠানোর বদলে বিক্রি করতেন বাইরে। এই চক্রের পিছনে কোনও বড় মাপের প্রভাবশালীর হাত আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে ইডি। যদিও গ্রেফতার হওয়ার পরে বাকিবুরের সংবাদমাধ্যমের সামনে দাবি, তিনি কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন।

তদন্তে নেমে ইতিমধ্যেই ইডি বাকিবুরের বিভিন্ন ব্যবসার সন্ধান পেয়েছে। সূত্রের খবর, অন্তত পাঁচটি চালকল এবং আটাকল আছে তাঁর। হোটেল ব্যবসা আছে। তার মধ্যে একটি হোটেল কলকাতার চিনার পার্কে এবং অন্যটি বেঙ্গালুরুতে। এ ছাড়াও, বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং বেশ কয়েকটি দামি বিদেশি গাড়ি আছে। তদন্তকারীদের সন্দেহ, আরও কিছু সম্পত্তি বেনামে থাকতে পারে। সেগুলির খোঁজ চলছে। বাকিবুর যে নিকটাত্মীয়দের নামে টাকা সরিয়েছেন, তার প্রমাণ এক আত্মীয়ের বয়ানে মিলেছে বলেও ইডি সূত্রে দাবি। তদন্তকারীদের সূত্রে আরও দাবি, বাকিবুর নিয়মিত দুবাই যাতায়াত করতেন। তারও প্রমাণ হাতে এসেছে। রেশন দুর্নীতির টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে ইডি সূত্রের দাবি।

Advertisement

আদতে বাকিবুরের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায়। মামাবাড়ির সূত্রে তিনি চালকলের মালিক হয়েছিলেন এবং সেই পুরনো চালকলে নতুন যন্ত্রপাতি বসিয়ে ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি করেন। ক্রমে চালকলের পাশাপাশি আটাকলও তৈরি করেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, বাম আমল থেকেই তিনি খাদ্য দফতরের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন। রাজ্যে পালাবদলের পরেও বর্তমান সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ‘অতি ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন বাকিবুর। সেই ছবি সামনে এনে ইতিমধ্যে আক্রমণও শানিয়েছেন বিরোধীরা।

উত্তর ২৪ পরগনার রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ, রাজ্যে পালাবদলের পরে ব্যবসার বহর ক্রমেই বাড়ছিল বাকিবুরের। ভাগচাষিদের কাছ থেকে ধান কেনা থেকে শুরু করে রেশনের জন্য চাল বিক্রি পর্যন্ত ধাপে ধাপে নানা দুর্নীতি চলে। যার সঙ্গে প্রশাসনের একাংশও যুক্ত বলে অভিযোগ।

বাকিবুরের চালকলে কাজ করা প্রাক্তন শ্রমিকদের একাংশের দাবি, ধান কেনার সময়ে তো নানা গরমিল হতই, উপরন্তু ভিন্‌ রাজ্য থেকে নিম্নমানের চাল আসত সেখানে। রাজ্যের ধান ভাঙিয়ে যে চাল হত, তার বদলে ওই নিম্নমানের চাল দেওয়া হত। সেই চালের গুণমান নিয়ে খাদ্য দফতরের তরফে কোনও দিনই আপত্তি করা হয়নি বলে অভিযোগ। প্রশাসনের অফিসারদের একাংশেরও বক্তব্য, এ সব জানলেও কিছু করার ছিল না। কারণ, এর শিকড়অনেক গভীরে।

আটাকলেও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন একদা বাকিবুরের কাছে কাজ করা শ্রমিকদের অনেকে। চালের মতো একই ভাবে নিম্নমানের গম কিনে যে আটা তৈরি হত, তা সরকারের কাছে যেত। ভাল গমের আটা (যা আদতে সরকারের প্রাপ্য) তা চলে যেত অন্যত্র।

বাকিবুরের কৈখালির ফ্ল্যাটে টানা ৫৩ ঘণ্টা তল্লাশির পরে শুক্রবার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছিল ইডি। শুক্রবার গভীর রাতে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। শনিবার কোর্টে হাজির করানো হলে বাকিবুরকে দু’দিনের জন্য হেফাজতে পায় ইডি। আজ, সোমবার বাকিবুরকে কলকাতার বিচার ভবনের বিশেষ সিবিআই আদালতে (ওই কোর্টেই ইডির মামলার শুনানি হয়) হাজির করানো হবে।

বাকিবুরের গ্রেফতারের পরে রাজনৈতিক তরজার পারদও চড়েছে। বিরোধীরা সুর চড়ালেও অভিযোগ খারিজ করছে তৃণমূল। রবিবার রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এই দুর্নীতির চর্চা দীর্ঘ দিন ধরে মানুষের মুখে মুখে। যে মাপের দুর্নীতি হয়েছে, তাকখনও কোনও ব্যবসায়ী কিংবা গ্রুপ-ডি কর্মীর পক্ষে একা করা সম্ভব নয়।’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয়কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘রেশন দুর্নীতি-কাণ্ডে যিনিগ্রেফতার হয়েছেন, তিনি খাদ্য দফতরে যথেষ্ট প্রভাবশালী বলে পরিচিত। খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার একাধিক ছবি, ভিডিয়ো আছে। ...দেগঙ্গা, বেনাচাপড়া ছেড়ে কৈখালিতে বিশাল ফ্ল্যাট, চিনার পার্কে ধনকুবেরের মতো সম্পত্তি, কলকাতা এমনকি বিদেশেও সম্পত্তি রয়েছে। তৃণমূলের নেতাদের মদতে লুট এবং দুর্নীতি হয়েছে। আসল মাথাদেরধরার মানসিকতা কি ইডি-সিবিআইয়ের আছে?’’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন বহরমপুরে বলেছেন, ‘‘রেশন-কাণ্ডে বিশাল দুর্নীতি আছে। এতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে। মন্ত্রী-সান্ত্রী, সরকার সবাই জড়িত। শুধুমাত্র কোভিডের সময়েই মিড-ডে মিলের চালের হাজার হাজার টন লুট হয়েছে। শিশুর খাবার বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এই তৃণমূলের নেতারা। ইডি-সিবিআইয়ের ক্ষমতা থাকলে তদন্ত করুক।”

তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘বিরোধীরা কুৎসা, অপপ্রচার করছে। এক জন ব্যবসায়ীর কোথায় কী সম্পত্তি রয়েছে, সেটা তৃণমূলের জানার কথা নয়। তাঁর সম্পত্তি বৈধ হলে, ঠিক আছে। অবৈধ হলে সেটা তদন্তকারীরা দেখবেন। কিন্তু এর সঙ্গে তৃণমূলকে জড়ানো হচ্ছে কেন? এ বার তো তা হলে চন্দন বসু, জয় শাহের ক্ষেত্রেও সিবিআই তদন্ত করতে হয়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement