দিলীপ ঘোষকে কি টপকে যেতে পারবেন সুকান্ত মজুমদার? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লোকসভা নির্বাচনে ৩৫টি আসন জিততে হবে। ‘লক্ষ্য’ বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং অমিত শাহ। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি বদলে গেলেও এখনও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শাহকেই দলের ‘সর্বেসর্বা’ মনে করেন বিজেপি নেতারা। পাঁচ বছর আগে সর্বভারতীয় সভাপতি থাকার সময়েই বঙ্গ বিজেপিকে ২২টি আসন জয়ের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিলেন শাহ। তখন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। বিজেপি জিতেছিল ১৮টি আসন। এ বার লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় দলের নেতৃত্ব দেবেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তাঁর কাছে দলের চাহিদা দিলীপের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ফলে কাজটা তুলনায় কঠিন। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও একান্তে তা মানেন অনেক রাজ্য নেতা। কারণ, দিলীপের আমলে বিজেপির হারানোর কিছু ছিল না। দুই থেকে আসন বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৮-য় পৌঁছেছিল পদ্মশিবির। কিন্তু এ বার ১৮-র উপরে যেতে হবে সুকান্তকে। কিন্তু মাঝের পাঁচ বছরে আগের জেতা আসনগুলির ‘পার্টিগণিত’ অনেকটাই বদলে গিয়েছে।
বস্তুত, গত বিধানসভা ভোটে বিজেপির ‘স্বপ্ন-বেলুন’ চুপসে যাওয়া অনেকটাই কঠিন করে দিয়েছে আসন্ন লোকসভা নির্বাচন নিয়ে আশা। ২০১৯ সালের ফল অনুযায়ী রাজ্যের বিধানসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে ১২১টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। আবার ১৮টি লোকসভার মোট ১২৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৯৬টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু ফলঘোষণার পর দেখা গিয়েছে, বিজেপি ৯৬-এর মধ্যে জয় পেয়েছে ৬০টিতে। তবে সে বার হেরে যাওয়া আসনেরও কয়েকটিতে জিতেছিল বিজেপি। যেমন কোচবিহারের শীতলখুচিতে ২০১৮ সালের লোকসভার ফলের নিরিখে বিজেপি পিছিয়ে ছিল। কিন্তু জয় পায় গত বিধানসভা নির্বাচনে। সেই সব হিসাব বাদ দিয়ে এগিয়ে থাকা ৩৭টি আসনে বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যায় বিজেপি।
সুকান্তের নিজের লড়াই অবশ্য তুলনায় সহজ। গত লোকসভা নির্বাচনের ফল ধরে রাখাই মূল লড়াই তাঁর বালুরঘাটে। ২০১৯ সালের মতো ২০২১ সালেও সাতটি বিধানসভার তিনটিতে জয় পায় বিজেপি। তবে দিলীপের জন্য ততটা সুখের নয় আসন্ন নির্বাচন। পাঁচ বছর আগে সাতের মধ্যে পাঁচটিতে এগিয়ে থেকে জিতেছিলেন দিলীপ। কিন্তু ২০২১ সালে জয় মেলে একটি মাত্র কেন্দ্র— খড়্গপুর সদরে। জেতেন তারকা প্রার্থী হিরণ চট্টোপাধ্যায়।
বিজেপির এ বারের লক্ষ্যকে ‘দিবাস্বপ্ন’ বলে আগেই কটাক্ষ করেছে তৃণমূল। তবে সুকান্তের দাবি লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভার ফলের তুলনা করা ঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দেখে মানুষ ভোট দেবেন। কেন্দ্রের উন্নয়ন দেখে ভোট দেবেন। বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের বিষয় ছিল আর আগামী ভোটে মানুষ ঠিক করে দেবেন বিশ্ব দরবারে ভারতের স্থান কোথায় হবে।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে তৃণমূলের একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে। রাজ্যের মন্ত্রী, তৃণমূল বিধায়ক, নেতারা জেলে। অন্য দিকে, গোটা দেশ ঠিক করে রেখেছে মোদী সরকারের হ্যাটট্রিক হবে। বাংলাও তাতে শামিল হবে।’’
বিধানসভা ভোটে উত্তরবঙ্গে খানিকটা ভাল ফল করলেও বিজেপি দক্ষিণবঙ্গে একেবারেই কোণঠাসা হয়ে যায় কয়েকটি জেলায়। ১৮টি আসনের বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, সবচেয়ে খারাপ ফল হুগলি ও ঝাড়গ্রামে। সেখানকার সাংসদেরা হলেন লকেট চট্টোপাধ্যায় এবং কুনার হেমব্রম। ওই দুই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত একটি বিধানসভা আসনেও জয় পায়নি বিজেপি। সবচেয়ে ভাল ফল হয় আলিপুরদুয়ার আসনে। ওই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সব বিধানসভা আসন দখলে রাখতে পেরেছিল বিজেপি। ২০১৯ এর মতো ২০২১ সালেও সাতে-সাত পান সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জন বার্লা। কিন্তু খাতায়কলমে বিজেপি বিধায়ক হলেও আলিপুরদুয়ারের সুমন কাঞ্জিলাল তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ফলে বার্লার আসনেও বিজেপি পুরোপুরি ‘নিরঙ্কুশ’ শক্তিধর বলা যাবে না।
কোচবিহার আসনে গত বিধানসভা নির্বাচনে খানিক এগিয়ে গিয়েছিল বিজেপি। সাতটি আসনের পাঁচটি বিধানসভায় লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এগিয়ে থাকলেও ২০২১ সালে জেতে ছ’টিতে। সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকও জিতেছিলেন। তবে পরে দিনহাটা আসনটি উপনির্বাচনে হারায় বিজেপি। ফলে এখনকার হিসাব বলছে কোচবিহারে বিজেপি সাতে-পাঁচ। অর্থাৎ, গত লোকসভা নির্বাচনের মতোই রয়েছে আসনের চিত্র।
তুলনায় ফল খারাপ সাংসদ জয়ন্তকুমার রায়ের আসনে। জলপাইগুড়ি লোকসভায় এগিয়ে থাকা তিনটি আসনে হার হয় বিজেপির। রাজু বিস্তার দার্জিলিঙেও বিধানসভা ভোটে একটি আসন কমেছিল বিজেপির। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীর রায়গঞ্জে অনেকটাই বদলেছে দলগত শক্তি। গত লোকসভা নির্বাচনে ওই আসনের চারটি বিধানসভা এলাকায় এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু বিধানসভা ভোটে জয় মেলে দু’টি আসন কালিয়াগঞ্জ এবং রায়গঞ্জে। কিন্তু দুই বিধায়কই (সৌমেন রায় এবং কৃষ্ণ কল্যাণী) যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। খগেন মুর্মুর মালদহ উত্তর লোকসভা আসনে একই অবস্থায় রয়েছে বিজেপি। ২০১৯-এ এগিয়ে থাকা তিনটি আসনেই বিজেপি জয় পেয়েছে গত বিধানসভা নির্বাচনে।
দক্ষিণবঙ্গে দলকে সবচেয়ে ভাল ফল দিতে পেরেছিলেন রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকার। লোকসভা নির্বাচনের মতো বিধানসভাতেও নবদ্বীপ ছাড়া বাকি ছ’টি আসনে জয় পেয়েছে বিজেপি। একই ছবি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের বনগাঁয়। বিধানসভা নির্বাচনে হার হয়েছিল শুধু স্বরূপনগরে। লোকসভা নির্বাচনেও ওই আসনে পিছিয়ে ছিল বিজেপি। তবে ‘কাঁটা’ হয়ে রয়েছেন বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। বিজেপির টিকিটে জিতলেও তিনি এখন ঘোষিত ভাবে তৃণমূলে।
বিজেপির হাল খারাপ অর্জুন সিংহের ব্যারাকপুরে। তৃণমূলে যোগ দিলেও খাতায়কলমে অর্জুন বিজেপি সাংসদ। ভাটপাড়ায় ছেলে পবন সিংহ ছাড়া এলাকার কোনও বিজেপি প্রার্থীই জেতেননি বিধানসভা নির্বাচনে। আর হুগলিতে তো সর্বত্র হার! লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ভাল ভোটে চুঁচুড়া কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু স্বয়ং সাংসদ লকেটই বিধানসভা নির্বাচনে ওই আসনে ১৮ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত হন তৃণমূলের কাছে। একই অবস্থা ঝাড়গ্রাম আসনেও। কুনারের এলাকায় লোকসভা নির্বাচনে পাঁচটিতে এগিয়ে থাকা বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে শূন্য হাতে ফেরে।
তব জঙ্গলমহলের আর একটি আসন পুরুলিয়ায় বিজেপির অবস্থা ততটা খারাপ হয়নি গত বিধানসভা নির্বাচনে। জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতর এলাকায় লোকসভা নির্বাচনে সবক’টি আসনে জয় পেলেও বিধানসভায় বাঘমুণ্ডি এবং মানবাজারে হারে বিজেপি। তবে বাঘমুণ্ডি আসনটি জোট সঙ্গী আজসুকে (অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) ছেড়েছিল বিজেপি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকারের এলাকা বাঁকুড়াতেও বিধানসভা নির্বাচনের ফল অনুসারে পরিস্থিতি সন্তোষজনক হয়নি। লোকসভায় সাতটি আসনেই জয় পেলেও বিধানসভায় বিজেপি জেতে চারটিতে। আবার সৌমিত্র খাঁয়ের বিষ্ণুপুর লোকসভা এলাকায় একটি আসন কমেছিল বিধানসভায়। বড়জোড়া হারানোয় ছয় থেকে কমে পাঁচ হয়। সম্প্রতি আবার কোতুলপুরের বিজেপি বিধায়ক হরকালী প্রতিহার তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এস এস অহলুওয়ালিয়ার বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে বিধানসভা ভোটে মাত্র একটিতে জয় পায় বিজেপি। গত লোকসভার ফলাফলে তারা এগিয়ে ছিল তিনটিতে।
অবশেষে আসানসোল। যে আসনে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে বিজেপি জিতলেও এখন আর সেটি তাদের হাতে নেই। প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এখন তৃণমূলের বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রী। ওই আসনে উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিংহ বিপুল জয় পান। উপনির্বাচনের ফলাফলকে গুরুত্ব না দিলেও আগে থেকেই ওই আসনে পিছিয়ে ছিল বিজেপি। ২০১৯ সালে ওই আসনের সাতটি বিধানসভার সাতটিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু গত বিধানসভায় জয় আসে শুধু দু’টিতে। আসানসোল দক্ষিণ এবং কুলটি।
শাহকে সন্তুষ্ট করতে গেলে এখন থেকেই কোমর বাঁধতে হবে সুকান্ত-শুভেন্দুদের।