নরেন্দ্র মোদী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বাংলার পাওনা, বকেয়া ইত্যাদির দাবিতে আগামী ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল সূত্রের খবর, সব পরিকল্পনামাফিক চললে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেই সাক্ষাতে মমতার সঙ্গেই থাকবেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, দু’জনের একসঙ্গে দিল্লি যাওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পাওয়ার পরেই মমতা জানিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে কয়েক জন সাংসদও থাকবেন। সেই প্রতিনিধিদলে অভিষেক থাকবেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। যে জল্পনায় ইন্ধন দিয়েছিল সাম্প্রতিক অতীতে তৃণমূলের বিভিন্ন নেতার প্রকাশ্যে বিবৃতি। যা থেকে বোঝা যাচ্ছিল, কোথাও একটা মতদ্বৈত তৈরি হয়েছে। যদিও তৃণমূল প্রত্যাশিত ভাবেই বিষয়টি ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘বিরোধীদের অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়ে এসেছে।
তৃণমূলের একাধিক সূত্রের বক্তব্য, দু’টি বিষয়ে ‘ভিন্নমত’-এর একটি পরিসর তৈরি হয়েছিল। প্রথম, রাজনীতিতে অবসরের বয়ঃসীমা। দুই, দলের অন্দরে ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতি। দু’টি বিষয় নিয়েই দলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকে প্রকাশ্যে মুখ খুলছিলেন। যাতে বিষয়টি নিয়ে জটিলতা আরও বাড়ছিল। অনেকে মনে করেন, সেই জটিলতায় আরও ইন্ধন জমা পড়েছিল বাংলার লোকজনের প্রাপ্য বকেয়া অর্থের দাবিতে অভিষেকের নেতৃত্বে আন্দোলন আচমকাই খানিকটা ‘গতি’ হারানোয়।
বাংলার বকেয়ার দাবিতে আন্দোলনকে দিল্লির রাজপথে পৌঁছে দিয়েছিলেন অভিষেকই। অক্টোবরের গোড়ায় যখন সেই আন্দোলন চলছে, তখন পায়ের সমস্যার কারণে মমতা ছিলেন গৃহবন্দি। যদিও বাড়ি থেকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। গান্ধীজয়ন্তীতে রাজঘাটে ধর্না, পরের দিন যন্তর মন্তরে বিক্ষোভের পর কৃষি ভবন অভিযান, পুলিশের ধরপাকড়— সব মিলিয়ে তৃণমূলের আন্দোলন দিল্লি-সহ জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে প্রত্যাশিত অভিঘাত তৈরি করতে পেরেছিল। দিল্লি থেকে ফিরে টানা পাঁচ দিন রাজ ভবনের উত্তর গেটের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন অভিষেক। রাজ্যপাল সময় দেওয়ার পর সেই আন্দোলন প্রত্যাহার করে তৃণমূলের সেনাপতি জানিয়েছিলেন, নভেম্বরের গোড়া থেকেই ফের আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু তা হয়নি। তৃণমূলের অন্দরে গুঞ্জন, ওই বিষয়েও সর্বোচ্চ স্তরে একটা ‘দ্বন্দ্ব’ তৈরি হয়েছিল। তার পরে দলের বিশেষ অধিবেশনের মঞ্চে অভিষেকের ছবি না থাকা, সেই অধিবেশনে সশরীরে তাঁর না যাওয়া (চোখের সমস্যার কারণে), কুণাল ঘোষদের ক্ষোভ উগরে দেওয়া, বয়সনীতি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক (যে বিতর্কে ফিরহাদ হাকিম, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, কুণালেরাও এক এক রকমের বিবৃতি দিতে শুরু করেছিলেন) তৈরি হওয়ায় তৃণমূলের মধ্যে নানাবিধ জল্পনা তৈরি হয়েছিল।
তার পরে অবশ্য পাহাড়ে পারিবারিক অনুষ্ঠানে মমতা-অভিষেক একসঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাঁদের একসঙ্গে দেখা যায়নি। সে দিক থেকে মোদীর সঙ্গে সাক্ষাতে মমতা-অভিষেকের একসঙ্গে যাওয়া তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের নিরিখে বিশেষ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। বাংলার শাসকদল সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে। তাতে থাকবেন অভিষেকও। তৃণমূল অবশ্য এতে ‘তাৎপর্য’ বা বিস্ময়ের কিছু দেখছে না। তাদের বক্তব্য, বিষয়টি একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। বাংলার বকেয়া নিয়ে আন্দোলনে অভিষেকই মূলত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফলে তিনি প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সাক্ষাতে যে দলনেত্রীর সঙ্গে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক।
মোদীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগের দিন, অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর দিল্লিতে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠক রয়েছে। মমতা সেখানে অন্যতম মুখ। আর অভিষেক সমন্বয় কমিটির সদস্য। সে দিনও মমতা-অভিষেককে অনেক দিন পর একই রাজনৈতিক মঞ্চে দেখা যাবে। পর দিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ।
তৃণমূলের নেতৃত্বের একটি বড় অংশের মতে অবশ্য এ সব ‘দ্বন্দ্ব’ বা ‘মতানৈক্য’ একেবারেই ‘মনগড়া’। মমতা দলের সর্বময় নেত্রী এবং অভিষেক সেনাপতি। এর মধ্যে ‘অন্য কিছু’ নেই।
তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের নেতারা যেমনই বলুন, গত দেড় মাস ধরে তৃণমূলে নানাবিধ বিষয়ে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ‘অবনিবনা’ নিয়ে দলের মধ্যে তো বটেই, রাজনৈতিক মহলেও নানা জল্পনা তৈরি হয়েছিল। যেমন দলের একটি অংশ সরাসরি বলতে শুরু করে, মমতাই সব। আর কেউ কিছু নন। আবার কুণাল বলেন, ‘‘মমতাদিই দলের মুখ। কিন্তু অভিষেক যে ভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংগঠনের হাল ধরেছেন, তাকেও অস্বীকার করা যায় না। বিষয়টা মমতা বনাম অভিষেক নয়, মমতা এবং অভিষেক।’’ বয়সবিধি নিয়ে কুণালের মন্তব্য, নতুন করে অধিষেকের মুখে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বসীমা উচ্চারিত হওয়া, মমতার কথা উল্লেখ করে আবার সৌগতের সেই বক্তব্য খণ্ডন করা, কল্যাণ এবং কুণালের বাগ্যুদ্ধ— সব মিলিয়ে তৃণমূলের মধ্যে মন্থন শুরু করেছিল। সেই আবহেই মমতা-অভিষেক বাংলার বকেয়া অর্থের দাবি নিয়ে একসঙ্গে যেতে চলেছেন মোদীর দরবারে।
উল্লেখ্য, বকেয়া নিয়ে অভিষেক গোড়া থেকেই ‘আগ্রাসী’ আন্দোলনের পক্ষে। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ বাংলার বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছিলেন। মমতা তাতে কিছুটা রাশ টেনেছিলেন ওই মঞ্চ থেকেই। দিল্লির আন্দোলন হোক বা কলকাতায় মিছিল শেষে রাজভবনের সামনে ধর্না— সবটাই ছিল জঙ্গি মেজাজে। আন্দোলনের মেজাজ কী হবে, তা নিয়েও তৃণমূলের মধ্যে বিভাজন ছিল বলে শোনা যায়। তবে শেষ পর্যন্ত অভিষেকের নেতৃত্বে ঠিক হয়, কোনও ‘মিনমিনে’ আন্দোলন হবে না। বলিষ্ঠতার সঙ্গে আন্দোলনে নামতে হবে। এই ধরনের নানা চাপানউতরের মধ্য দিয়েই তৃণমূল চলছিল বেশ কিছু দিন ধরে। তবে দলের অনেকেই মনে করেছিলেন, পাহাড়ে পারিবারিক অনুষ্ঠানেই ‘শৈত্য’ কেটে যাবে। সর্বময় নেত্রী এবং সেনাপতি জোটবদ্ধ হয়েই প্রশাসন এবং দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।