এক জন পুরমাতা। অন্য জন দলেরই যুবনেতা। দু’জনের ‘ব্যক্তিগত সম্পর্ক’ নিয়ে হইচই রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে। পুরমাতা পাপিয়া হালদারের অভিযোগ, তাঁকে বিয়ে করতে চান যুবনেতা প্রতীক দে। কিন্তু তাঁকে প্রত্যাখ্যান করায় নিজের ওয়ার্ডের মানুষকে পরিষেবা দিতে পারছেন না তিনি। অন্য দিকে, যুবনেতার দাবি, তাঁদের সম্পর্ক ছিল। এখন এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ করছেন পাপিয়া। পুরমাতা বনাম যুবনেতার এই ‘যুদ্ধে’ শোরগোল রাজপুর-সোনারপুর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে। ঝগড়া গড়িয়েছে থানা-পুলিশ পর্যন্ত।
পাপিয়ার রাজনৈতিক উত্থান প্রতীকের হাত ধরেই। সোনারপুর দক্ষিণের প্রাক্তন বিধায়ক জীবন মুখোপাধ্যায় থেকে বর্তমান পুরপ্রধান পল্লবকান্তি দাস— সবার সঙ্গে পাপিয়ার পরিচয় করিয়ে দেন প্রতীক। ক্রমশ রাজপুর-সোনারপুরের রাজনীতিতে পাপিয়ার পরিচিতি বাড়তে শুরু করে। তখন প্রতীককেই রাজনৈতিক গুরু হিসাবে মানতেন পাপিয়া। একসঙ্গে বিভিন্ন রাজনীতির মঞ্চে দেখা যায় তাঁদের। কিন্তু আজ দু’জনের দুটো পথ দুই দিকে। কাউন্সিলরের অভিযোগ, তাঁর দুর্নাম করা হচ্ছে। যুবনেতার অভিযোগ, কাউন্সিলরের ‘লাইফস্টাইল’ বদলে গিয়েছে। ঝকঝকে গাড়ি চড়েন কাউন্সিলর। দামি ফোন ব্যবহার করেন। মিনারেল ওয়াটার ছাড়া নাকি জলই খান না।
পাপিয়া হালদারের আদি বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার লক্ষ্মীকান্তপুরে। বাবা কলকাতা পুলিশের কর্মী। বাবার কাজের সূত্রে দীর্ঘ দিন ধরে রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। বস্তুত, পাপিয়া এবং তাঁর ভাইয়ের জন্মও এখানেই।
পদ্মমণি গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেন পাপিয়া। তার পর বোসপুকুর কলেজ। কলেজে পড়াশোনা করতে করতেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি বছর ২৮-এর পাপিয়ার। ২০১৬ সালে রাজপুর-সোনারপুর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কো-অর্ডিনেটর হওয়ার সুবাদে সেখানকার কাজকর্ম করতে করতে প্রতীকের আলাপ পাপিয়ার সঙ্গে।
পুরমাতা এবং যুবনেতার ঘনিষ্ঠদের কয়েক জনের দাবি, পাপিয়ার বাড়ির সামনে পুরসভার একটি পয়ঃপ্রণালীর তদারকির কাজ করতে গিয়ে প্রথম দেখা হয় দু’জনের। পরে ফেসবুকে ‘বন্ধু’ হন তাঁরা। রাজনীতির মাধ্যমে ক্রমশ যোগাযোগ আরও বাড়ে। ২০১৬ সালের সরস্বতী পুজোর দিন একসঙ্গে দেখা যায় বর্তমান পুরমাতা এবং যুবনেতাকে। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, পাপিয়া এবং প্রতীক ‘বিশেষ সম্পর্কে’ আছেন বলেই জানতেন তাঁরা।
প্রতীকের হাত ধরেই সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন কলেজপড়ুয়া পাপিয়া। তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের মতে, পাপিয়ার কাউন্সিলর হওয়াতেই অনেকটাই প্রতীকের অবদান আছে। তৃণমূলের স্থানীয় কর্মীরা বলছেন, প্রতীককে দেখেই পাপিয়াকে ভোট দিয়েছেন তাঁরা।
কিন্তু এ হেন প্রতীক এবং পাপিয়ার সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। যদিও পাপিয়ার অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে শুধু কাজের সম্পর্ক যুবনেতার। কিন্তু প্রতীক নিজে পাপিয়াকে তাঁর ‘বৌ’ বলে প্রচার করেছেন। তার জন্য অস্বস্তিতে পড়েছেন তিনি। এমনকি, বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় দলবল নিয়ে তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাণ্ডব করেছেন।
পাপিয়ার ঠিক কী কী অভিযোগ? ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের অভিযোগ বিস্তর। তাঁর দাবি, কাউন্সিলর হয়েও তাঁকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে জোর করা হচ্ছে। তিনি তাঁর ওয়ার্ডের মানুষদের জন্য কাজ করতে পারছেন না। পাপিয়ার কথায়, ‘‘আমার ওয়ার্ডের মানুষকে নাগরিক পরিষেবাটুকু দিতে পারছি না আমি। কারণ, কার্যালয়ের সামনে তালা মেরে দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘তোমায় পরিষেবা দিতে হবে না।’ ওর (প্রতীক) ব্যক্তিগত চাহিদা ছিল। সেটা পূরণ হচ্ছে না দেখে এই বাধা।’’ কী সেই ব্যক্তিগত চাহিদা? পাপিয়ার কথায়, ‘‘ও সবাইকে বলে বেড়াত, আমি ওর বৌ। রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছে। আমি এর প্রতিবাদ করি। আমার সঙ্গে শুধু কাজের সম্পর্ক ওর।’’
তৃণমূল যুবনেতা প্রতীকের বিরুদ্ধে কাউন্সিলর পাপিয়ার আরও অভিযোগ রয়েছে। তিনি দাবি করেন, তাঁর নাম করে টাকা তুলেছেন প্রতীক। এলাকার খাসজমি দখল করে বিক্রি থেকে তাঁর নাম করে ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা তোলা— বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করা হয়েছে তাঁর নাম করে। পাপিয়ার কথায়, ‘‘২০২০ সালে করোনা পরবর্তী সময় থেকে প্রতীক এবং আরও বেশ কয়েক জন তৃণমূল নেতা অসাধু কাজে যুক্ত হন। এবং আমাকে তাঁদের শিখণ্ডি হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করেন।’’
কিন্তু এই অভিযোগ আগে কেন করেননি? কাউন্সিলরের দাবি, মৌখিক ভাবে স্থানীয় বিধায়ক থেকে পুরপ্রধান এবং তৃণমূল নেতৃত্ব সবাইকে তিনি বিষয়টি জানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে। তিনি ভয়ে-ভয়ে রয়েছেন। কাউন্সিলরের কথায়, ‘‘আমাকে বলা হচ্ছে, ওয়ার্ড ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু আমি তো কোনও দুর্নীতি করিনি। শুধুমাত্র বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য কাউন্সিলর পদ ছেড়ে দিতে হবে?’’
পাপিয়ার দাবি, তিনি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে রাজনীতিতে এসেছেন। তাই মমতা কিংবা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যদি বলেন, তবেই তিনি রাজনীতি ছাড়বেন। পাপিয়া জানান, ইতিমধ্যে দাদার মাধ্যমে থানায় প্রতীকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। যে হেতু তিনি সশরীরে অভিযোগ জানাতে পারেননি, তাই এফআইআর হয়নি। থানায় জিডি (জেনারেল ডায়েরি) হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে।
অন্য দিকে, প্রতীকের দাবি, মিথ্যা অভিযোগ করছেন পুরমাতা। প্রতীকের কথায়, ‘‘যে কেউ অভিযোগ করতেই পারেন। কিন্তু তার সারবত্তা কী, সেটা প্রমাণ করতে হবে। দলের কাছে তো উনি (পাপিয়া) বিষয়টি জানিয়েছেন। দল খোঁজ নিয়ে দেখুক। সেখানে যদি আমাকে দোষী বলা হয়, তা হলে যা শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেব। আমি যে কোনও তদন্তের জন্য প্রস্তুত।’’
প্রতীক বলছেন, এক জন কাউন্সিলর নিয়ে তো দল নয়। অন্যান্য নেতা আছেন। ওয়ার্ডের কর্মীরা আছেন। তাঁরাই বলবেন, কাউন্সিলরের সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক ছিল। এর পর প্রতীক আঙুল তুলেছেন পাপিয়ার জীবনধারা নিয়ে। তাঁর অভিযোগ, পুরসভা থেকে তিনি এক লক্ষ করে টাকাও চেয়েছিলেন। পাপিয়ার ‘লাইফস্টাইল’ কোনও সাধারণ কাউন্সিলরের মতো নয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
কিন্তু পাপিয়া তো তাঁর বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ করছেন! প্রতীকের জবাব, ‘‘আমি অত্যন্ত সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করি। সাধারণ পোশাক পরি। একটা স্কুটি নিয়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে যাই। আমার ফোনটিও সাধারণ। আর কাউন্সিলর দামি গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ান। দামি ফোন। মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খান না। সপ্তাহান্তে পার্টি করেন। কিন্তু ওয়ার্ডের কোনও কাজ করছেন না। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ দলীয় কর্মী এবং সমর্থকেরা।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, কলকাতা পুলিশের এক অফিসারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে তাঁকে নিয়ে অভিযোগ তুলছেন পাপিয়া।
প্রতীক এবং পাপিয়ার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, এ বার দুর্গাপুজোর পর থেকেই সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে তাঁদের। দেশের বাড়ি যাওয়ার নাম করে কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিকের সঙ্গে নাকি সিকিমে বেড়াতে যান পাপিয়া। প্রতীকের অভিযোগ, কলকাতা পুলিশের ওই আধিকারিককে দিয়ে এলাকায় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন পাপিয়া। সাধারণ বাসিন্দাদের ভয়ও দেখাচ্ছিলেন নানা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার। তৃণমূল সূত্রে খবর, দলীয় নেতৃত্ব বিষয়টি মেটানোর চেষ্টা করলেও দু’জনের সম্পর্ক পুরোপুরি তলানিতে ঠেকে যাওযায় তা আর সম্ভব হয়নি।