ভারতেও পাওয়া গিয়েছে ওমিক্রনের নমুনা। ছবি: পিটিআই।
কোভিড সংক্রমণ যখন কমতে শুরু করেছিল বিশ্ব জুড়ে, তখনই আবার উদ্বেগ তৈরি করেছে ‘ডেল্টা’-র মতোই কোভিডের আরেকটি প্রজাতি ‘ওমিক্রন’। যা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তার পর তা অন্য কিছু দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতেও পাওয়া গিয়েছে ওমিক্রনের নমুনা।
ওমিক্রন কতটা চিন্তার এবং তার নিরাময়ে কী কী করা উচিত, তা নিয়ে আমরা প্রশ্নোত্তরের আকারে কথা বলেছিলাম শহরের তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে। তিন জনকেই চারটি নির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছিল। তাঁদের জবাব পর পর সাজিয়ে দেওয়া হল।
ওই তিন চিকিৎসক হলেন যোগীরাজ রায় (সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, দীর্ঘদিন বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে কোভিড রোগীদের চিকিৎসারত), সুস্মিতা রায়চৌধুরী (ডিরেক্টর অফ পালমোনোলজি, ফর্টিস হাসপাতাল) এবং শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক (পিয়ারলেস হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর, রিসার্চ। টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিশেষজ্ঞ)।
১) প্রশ্ন: ওমিক্রন নিয়ে বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত কেন?
যোগীরাজ: বিভিন্ন তথ্য এবং পরিসংখ্যান বলছে, কোভিডের আগের প্রজাতিগুলোর থেকে ওমিক্রন দ্রুত ছড়াতে সক্ষম।
সুস্মিতা: ডেল্টার থেকে জিনের বিন্যাসের পরিবর্তন হওয়ায় এটা নিয়ে উদ্বেগ আছে যে, সংক্রামক হওয়ার পাশাপাশি এই প্রজাতি ঘাতক হয়ে উঠবে কি না।
শুভ্রজ্যোতি: দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যা তথ্য সামনে এসেছে তাতে ওমিক্রন ডেল্টার থেকে বহুগুণ বেশি সংক্রামক। এটাই চিন্তার মূল এবং একমাত্র কারণ।
২) প্রশ্ন: কোভিডের বর্তমান টিকা ওমিক্রন থেকে কতটা সুরক্ষা দেবে?
যোগীরাজ: বর্তমানে কোভিডের টিকাগুলো ওমিক্রন থেকেও নিশ্চিত ভাবে কিছুটা সুরক্ষা দেবে। তবে পুরোপুরি কাজ করবে কি না এখনই বলা মুশকিল।
সুস্মিতা: এখন যে টিকাগুলো দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো কোভিডের বিরুদ্ধে ৬৫%-৭০% সুরক্ষা দিতে সক্ষম। ওমিক্রনের বিরুদ্ধেও এই টিকা সুরক্ষা দিতে সক্ষম বলেই জানতে পারছি।
শুভ্রজ্যোতি: আশা করা যাচ্ছে কোভিডের টিকা ওমিক্রনের বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু আরও গবেষণা এবং সময় এই প্রশ্নের শেষ উত্তর দেবে।
ডেল্টার থেকে বহুগুণ বেশি সংক্রামক ওমিক্রন । ছবি: পিটিআই।
৩) প্রশ্ন: উন্নতমানের বুস্টার না আসা পর্যন্ত কি আমাদের অপেক্ষা করা উচিত?
যোগীরাজ: এখনই ওমিক্রনের বিরুদ্ধে বুস্টার কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে না ভেবে বা বুস্টারের জন্য লাফালাফি না করে নতুন টিকার গবেষণা করা উচিত। কারণ, এই ধরনের ভাইরাস তাদের চরিত্র বদলাতে থাকে।
সুস্মিতা: আমাদের দেশে বুস্টার দেওয়ার কথা চলছে। তবে নির্দিষ্ট বুস্টার যে ওমিক্রনের থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে, এমন কোনও প্রমাণ এখনও নেই।
শুভ্রজ্যোতি: এক কথায় বলতে গেলে বুস্টার ডোজ অবিলম্বে চালু করা উচিত। বিশেষত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী-সহ প্রথম সারির করোনা যোদ্ধাদের জন্য বুস্টার এখনই চালু করতে হবে।
৪) প্রশ্ন: সুরক্ষার জন্য আমাদের কী করা উচিত?
যোগীরাজ: আলফা, বিটা, ডেল্টা হোক বা ওমিক্রন— করোনাবিধি একই থাকবে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং দূরত্ববিধি বজায় রাখাই সুরক্ষার মূল মন্ত্র।
সুস্মিতা: টিকা নেওয়ার পর বা একবার কোভিড হয়ে যাওয়ার পরেও মাস্ক পরে থাকতে হবে। দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার অজুহাতে মাস্ক খুললে চলবে না। তা হলেই ওমিক্রন থেকে সুরক্ষিত থাকবেন।
শুভ্রজ্যোতি: ওমিক্রনের জন্য আলাদা করে কোনও সুরক্ষাবিধি নেই। প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষ নিজের কর্তব্য পালন করলেই সকলে সুরক্ষিত থাকব।
ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতাই মূলত ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। যোগীরাজের যেমন বক্তব্য, ‘‘বিভিন্ন তথ্য এবং পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, কোভিডের আগের প্রজাতিগুলোর থেকে ওমিক্রন দ্রুত ছড়াতে সক্ষম। এর ফলে ডেল্টা বা ডেল্টা প্লাসের থেকে বেশি রোগী সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা। রোগী বাড়লে বেশি মানুষ অসুস্থও হবেন।’’ তবে যোগীরাজ জানাচ্ছেন, ওমিক্রনে আক্রান্তদেরও একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা হবে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা-সহ চিকিৎসা পরিকাঠামো থাকলে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুত রাজ্য প্রশাসন।
বর্তমানে কোভিডের টিকাগুলো ওমিক্রন থেকেও নিশ্চিত ভাবে কিছুটা সুরক্ষা দেবে। মনে করেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ যোগীরাজ রায়। ছবি: পিটিআই।
সুস্মিতা জানাচ্ছেন, ওমিক্রন বেশি সংক্রামক কি না সেটাই প্রশ্ন এবং চিন্তার বিষয় ছিল। পাশাপাশি, ডেল্টার থেকে এটি বেশি ঘাতক কি না, তা নিয়েও চিন্তিত ছিলেন বিশেষজ্ঞরা।। ওমিক্রন কোভিডের আগের প্রজাতিগুলোর থেকে বেশি ঘাতক বলে আপাতত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাঁর কথায়, ‘‘যেহেতু ডেল্টার থেকে জিনের বিন্যাসের পরিবর্তন হয়েছে, তাই বিশেষজ্ঞরা ভয় পাচ্ছেন, এটিও ঘাতক হয়ে উঠবে কিনা। যদিও তার কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।’’ শুভ্রজ্যোতির কথায়, ‘‘দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যা তথ্য সামনে এসেছে তাতে ওমিক্রন ডেল্টার থেকে বহুগুণ বেশি সংক্রামক। এটাই চিন্তার মূল এবং একমাত্র কারণ। এতে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। হাসপাতালগুলোয় আবার কোভিড রোগীর ভিড় বাড়বে। ওমিক্রনের জন্য কোভিডের নতুন ঢেউ উঠলে তা সামাল দেওয়াটাই চিন্তার কারণ।’’
কোভিডের টিকা ওমিক্রনে কাজ করবে কি না, তা নিয়েও অভিমত দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। যোগীরাজের বক্তব্য, ‘‘এই টিকাগুলো ওমিক্রন থেকেও নিশ্চিত ভাবে কিছুটা সুরক্ষা দেবে। তবে পুরোপুরি কাজ করবে কি না এখনই বলা মুশকিল।’’ সুস্মিতা বলছেন, ‘‘ওমিক্রনের বিরুদ্ধেও বর্তমান টিকা সুরক্ষা দিতে সক্ষম বলেই জানতে পারছি আমরা। এখনই আলাদা করে কোনও টিকা নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে না। টিকা নিলে কোভিড সংক্রমনের পরেও দ্রুত সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন আক্রান্তরা। তাই যত বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া যায় ততই ভাল।’’ শুভ্রজ্যোতির মতে, ‘‘কোভিডের বর্তমান প্রজাতির মতো ওমিক্রনের বিরুদ্ধেও টিকা একই ভাবে কাজ করবে কি না সেটা নিশ্চিত করে বলার মতো পর্যাপ্ত তথ্য বা পরিসংখ্যান এখন আমাদের হাতে নেই। এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে কোভিডের টিকা নেওয়ার পরও যাঁরা ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের কেউ গুরুতর অসুস্থ হননি। কোভিডের টিকা নেওয়ার পরও ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এরও প্রমাণ নেই।’’ অর্থাৎ, টিকার কাজ করার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেই সূত্রেই শুভ্রজ্যোতি বলছএন, ‘‘টিকা একেবারেই কাজ করবে না বলা যায় না। মাথায় রাখতে হবে, ভাইরাসের কিছু বদল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মারাত্মক বদলে গিয়েছে এমনটা বলা যাবে না। ওমিক্রনের চরিত্র বুঝে গেলে নতুন টিকাও তৈরি হবে। যেমন মর্ডানা ও ফাইজার জানিয়েছে।’’
টিকার বুস্টার চালু করা নিয়েও তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সুস্পষ্ট অভিমত রয়েছে। যোগীরাজের বক্তব্য, ‘‘বর্তমানে কোভিডের যে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো ওমিক্রনকে রুখতে কতটা কার্যকর, তারই পর্যাপ্ত পরিসংখ্যান নেই আমাদের হাতে! তাই এখনই ওমিক্রনের বিরুদ্ধে বুস্টার কতটা কাজে দেবে বা বুস্টারের জন্য লাফালাফি না করে নতুন টিকার গবেষণা করা উচিত। এই ধরনের ভাইরাস তাদের চরিত্র বদলাতে থাকে। কোভিড যেমন নিজেকে বদল করছে তেমন নতুন প্রজাতির কথা মাথায় রেখে টিকার পরিবর্তন করা যেতে পারে।’’ সুস্মিতার মতে, নির্দিষ্ট বুস্টার যে ওমিক্রনের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে, এমন কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।’’ আবার শুভ্রজ্যোতি চান, অবিলম্বে বুসল্টার ডোজ টচালু করা হোক। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম দিকে যাঁরা টিকা নিয়েছিলেন তাঁদের প্রায় ন’মাস হয়ে গেল। বিভিন্ন গবেষণা থেকে অ্যান্টিবডি কমে যাওয়ার তথ্য সামনে আসছে। তাই প্রথমসারির যোদ্ধাদের ক্ষেত্রে অপেক্ষা না করে বুস্টার দেওয়া উচিত।’’ পাশাপাশিই, শুভ্রজ্যোতি মনে করেন, ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কোন টিকা সুরক্ষা দিতে সক্ষম, তা নিয়ে গবেষণা চালাতে হবে। ওমিক্রনের চরিত্র বুঝে বুস্টারেও বদল করে দিলে সেটা নিশ্চয়ই কাজ করবে। তবে বুস্টার দেওয়ার ক্ষেত্রে অপেক্ষা করা উচিত নয়।