গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
শনিবার নয়াদিল্লিতে তাঁর নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। মনমোহন সিংহের সঙ্গেই সম্ভবত বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাবে এই ইতিহাসও যে, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলই ছিল পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের ‘সূতিকাগৃহ’।
মনমোহন যে এক দশক দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছিল ‘ঐতিহাসিক’ রাজনৈতিক ওলটপালট। মনমোহনের প্রথম মেয়াদ শুরু হয়েছিল যে ভাবে, শেষ পর্বে গিয়ে তা বদলে যায়। তৈরি হয় নতুন সমীকরণ। দ্বিতীয় তথা শেষ মেয়াদের শুরু যে ভাবে হয়েছিল, মাঝপথে সেই সমীকরণও বদলে গিয়েছিল।
মনমোহন জমানাতেই বাংলার রাজনীতির শিখরে পৌঁছেছিল বামেরা। আবার সেই পর্বেই তাদের ধস নামার শুরু। যে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছিল ২০১১ সালে। বামেদের ৩৪ বছরের সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল। যে পালাবদলে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল মনমোহনের দল কংগ্রেস। বামেদের সঙ্গে সখ্য দিয়ে মনমোহনের শাসনকাল শুরু হলেও তা তিক্ত হয়ে পড়ে চার বছরের মধ্যেই। বামেরা দূরত্ব বৃদ্ধি করতেই সেই পরিসরে ঢুকে পড়ে তৃণমূল। বঙ্গ রাজনীতির তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তা অনিবার্যও ছিল। পরে তৃণমূলও দূরত্ব বাড়িয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে। কিন্তু মনমোহনের সরকার থেকে বামেরা সমর্থন প্রত্যাহার করার পরে বাংলার রাজনীতিতে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে সিপিএম। অন্য দিকে, দ্বিতীয় মনমোহন সরকার থেকে মমতার দল বেরিয়ে এলেও বাংলায় এখনও পর্যন্ত তারাই ‘শেষ কথা’ হয়ে রয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, বামেদের যেমন ক্ষয় হয়েছে, তৃণমূল তেমনই নিজেদের জমি শক্ত করেছে বাংলার মাটিতে।
২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে বাংলায় ৩৫টি আসন পেয়েছিল বামেরা। গোটা দেশে তারা ছিল ৬১। ফলে শরিক নির্ভরতায় মনোমহনের অন্যতম শক্তি ছিল বাম দলগুলি। তাঁর সরকারে অবশ্য সরাসরি যোগ দেয়নি বামেরা। বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। তৈরি হয়েছিল ‘অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি’। যদিও ২০০৮ সালে পরমাণু চুক্তি নিয়ে বামেদের সঙ্গে সংঘাত বাধে কংগ্রেসের। সংখ্যার শক্তি দিয়ে মনমোহন সরকারকে বিপন্ন করার হুঁশিয়ারিও দিতে থাকে বামেরা। তৎকালীন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পদত্যাগের হুইপ দিয়েছিল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি। কিন্তু তিনি তা অগ্রাহ্য করায় সোমনাথকে বহিষ্কার করে দল। মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেও লাভ হয়নি বামেদের।
উল্লেখ্য, ১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বাংলায় ক্ষমতায় থাকা সিপিএম একমাত্র ২০০৬ সালের ভোটেই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বামফ্রন্টের ২৩৫টি আসন নিয়ে। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই তা ভাঙতে শুরু করে।
বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের যে তিক্ততা সর্বভারতীয় স্তরে তৈরি হয়েছিল, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে বাংলায়। তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ হতে শুরু করে কংগ্রেসের। সেই পর্বেই বঙ্গ রাজনীতিতে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের মতো ঘটনা ঘটেছে। সেই আবহে বাম-বিরোধী আন্দোলনে তৃণমূল পাশে পেয়ে গিয়েছিল কংগ্রেসকেও। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট বামেদের কোণঠাসা করে। আসনসংখ্যায় এক থেকে বেড়ে ১৯-এ পৌঁছয় তৃণমূল। ৩৫ থেকে ১৫ আসনে নেমে আসে বামেরা। সেই ভোটই প্রথম দেখিয়েছিল, সিপিএম হারতে পারে। সিপিএমকে হারানো সম্ভব। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে ভাল ফল ‘রক্তের স্বাদ’ দিয়েছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোটকে।
মনমোহনের মৃত্যুর পরে বাম, কংগ্রেস এবং তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের আলোচনায় উঠে আসছে সেই ইতিহাস। একান্ত আলোচনায় তিন শিবিরের নেতারাই মানছেন, বামেরা যদি প্রথম মনমোহন সরকারের উপর থেকে সমর্থন না তুলত, তা হলে রাজ্য রাজনীতিতে ওলটপালট না-ও হতে পারত। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘প্রথম ইউপিএ সরকারে ১০০ দিনের কাজ, তথ্য জানার অধিকার আইন, মিড ডে মিলের মতো অনেক কাজ সম্ভব হয়েছিল বামেদের জন্যই। কিন্তু সব বিষয়ে সব সময় সব পক্ষ এক মত হয় না। এটা রাজনীতির অঙ্গ।’’ আবার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার স্পষ্টই বলছেন, ‘‘বামেরা সমর্থন প্রত্যাহার না করে নিলে বাংলার রাজনীতিতে অবস্থার পরিবর্তন হত কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’’ সেই সঙ্গেই শুভঙ্করের সংযোজন, ‘‘তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র যারা শরিক, আমি তাদের সকলের সঙ্গেই সখ্য রাখার পক্ষে।’’ ঘটনাচক্রে, সেই ‘ইন্ডিয়া’য় বাম, তৃণমূল উভয়েই রয়েছে। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘মমতাদি সিপিএমকে উৎখাত করার আন্দোলন অনেক দিন ধরেই করছিলেন। কিন্তু ওই পরিস্থিতি (বামেদের সমর্থন প্রত্যাহার) মরণকামড় দেওয়ার সুবর্ণসুযোগ করে দিয়েছিল।’’
২০১১ সালে বাংলায় মমতার সরকারে শরিক হয়েছিল কংগ্রেস। যেমন কেন্দ্রে মনমোহনের দ্বিতীয় সরকারে অন্যতম শরিক ছিল তৃণমূল। একাধিক মন্ত্রীও পেয়েছিল তারা। কিন্তু ২০১২ সালে সেই তৃণমূলই মনমোহন সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। পাশাপাশি, বাংলাতেও মমতার নেতৃত্বাধীন সরকার থেকে বেরিয়ে আসে কংগ্রেস। বাম এবং তৃণমূল— দুই শিবিরই মনমোহনের দুই সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল। ঘটনাপরম্পরা বলছে, তার ফলে বামেদের রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল। আর তৃণমূলের রাজনৈতিক লাভ।
রাজনৈতিক পরিসরে উঠে আসছে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের সময়ে তৃণমূলের পাশে থাকা নিয়ে দিল্লির কংগ্রেসের ভূমিকার কথাও। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা দিয়ে তৃণমূলের পাশে ছিল কংগ্রেস। এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতার কথায়, ‘‘ওই ভোটে যে ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী কাজ করেছিল, তা নজির হয়ে রয়েছে। গণনাকেন্দ্রে সিপিএম কিছু করতেই পারেনি। যার নেপথ্য কারিগর ছিলেন সনিয়া গান্ধী, প্রণব মুখোপাধ্যায়।’’
পরমাণু চুক্তি নিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার সঠিক হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্ন বাম মহলেও রয়েছে। অনেকেই এ বিষয়ে সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের ভূমিকাকে দায়ী করেন। আবার অনেকে বলেন, সিপিএমের মতো দলে কারাটের একার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। তবে এ কথা ঠিক যে, সিপিএম যাতে প্রথম ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন না প্রত্যাহার করে, সে ব্যাপারে অধুনাপ্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরিকে ডেকে বুঝিয়েছিলেন প্রণব। বুঝিয়েছিলেন, সমর্থন প্রত্যাহার করলে বাংলায় বামেদের সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে। বাস্তবে তা-ই হয়েছিল।
পরিবর্তনশীল রাজনীতিতে বাংলায় কংগ্রেস এখন বামেদের ‘বন্ধু’। মনমোহন যখন চলে গেলেন, তখন বঙ্গ রাজনীতিতে বাম-কংগ্রেস প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত। আধিপত্য নিয়ে একার শক্তিতে সরকারে তৃণমূল। বদল বলতে একটাই— বাংলার রাজনীতির প্রধান বিরোধী দল এখন বিজেপি। ১০ বছর আগে এ রাজ্যের রাজনীতিতে যাদের কোনও দাপটই ছিল না!