চারিদিকে শুধু মৃতদেহের স্তূপ। তাকে ঘিরে রয়েছে পুলিসবাহিনী। অপরিচিত নারী ও পুরুষ কণ্ঠলগ্ন হয়ে পিষে মরেছে।... যে দেহ ও রূপ ঘিরে অনেক লজ্জা, অনেক সজ্জা, তা আজ ঠাণ্ডা, স্পন্দনহীন স্তূপীকৃত।” ১৯৫৪ সালের ইলাহাবাদের (এখনকার প্রয়াগরাজ) কুম্ভমেলায় মৌনী অমাবস্যার পুণ্যলগ্নে স্নান করতে এসে পদপিষ্ট হয়ে কয়েকশো মানুষের মৃত্যুমিছিলের বর্ণনা এই ভাবেই উঠে এসেছিল কালকূটের কলমে, তাঁর লেখা অমৃতকুম্ভের সন্ধানে-র পাতায়। একাত্তর বছর পর সেই পঙ্ক্তিগুলি যেন একই রকম তীব্রতায় ফের আছড়ে পড়ল সেই প্রয়াগরাজেই, মহাকুম্ভের প্রান্তরে, আর এক মহা পুণ্যলগ্নে। সেখানে পদপিষ্ট হয়ে নিহতের সংখ্যা সরকারি মতে ত্রিশ, প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে আরও কয়েক গুণ বেশি। যোগী-সরকারের ‘বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা’ কেন ব্রাহ্ম মুহূর্তে এমন ভাবে পদপিষ্ট হল, তার পিছনে উঠে আসছে ব্যারিকেড ভেঙে পড়ার ঘটনা। সরকারি মতে, সঙ্গম যাওয়ার পথে আখড়া মার্গের কাছে ব্যারিকেড ভেঙে ভিড় এগোতে থাকে, এবং পথে শুয়ে থাকা পুণ্যার্থীদের পিষে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অন্য রকম— পথের পন্টুন ব্রিজগুলি আটকে পুণ্যার্থীদের এগোতে বাধা দেয় পুলিশ। তাঁদের উপর লাঠিচার্জও করা হয়। ফলে আতঙ্কিত মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লে পদপিষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
কেন কয়েক মুহূর্তে পরিস্থিতি এমন প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে, তার প্রকৃত কারণ সম্ভবত মেলাপ্রাঙ্গণেই চিরতরে চাপা পড়ে থাকবে। কিন্তু এর পিছনে যে প্রশাসনিক অদক্ষতা, এবং অ-মানবিকতার চিত্রটি উঠে এল, তাকে ধামাচাপা দেওয়া কঠিন। যোগী সরকার দীর্ঘ ক্ষণ এমত দুর্ঘটনাকে গুরুত্বহীন দেখানোর প্রাণপণ প্রয়াস জারি রেখেছিল, হতাহতের সংখ্যা নিয়ে অস্পষ্টতা বজায় ছিল। ত্রিশটি প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরেও প্রাণহানির উল্লেখমাত্র না করে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’। শুধুমাত্র তা-ই নয়, বিশৃঙ্খলার মূল দায়টি তিনি প্রাথমিক ভাবে পুণ্যার্থীদের উপরেই চাপিয়েছিলেন। এই প্রত্যেকটি ঘটনা প্রশাসনিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং মাত্রাতিরিক্ত অহংবোধের পরিচায়ক, যা পরবর্তী সময়ে যোগীবরের অশ্রুসজল বেদনাপ্রকাশেও চাপা পড়ে না। কুম্ভমেলার ইতিহাসে দুর্ঘটনার সংখ্যাটি কম নয়। ১৮২০ সাল থেকে শুরু করে একাধিক বার সেখানে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সুতরাং, ১৪৪ বছর পর আসা এক মহা পুণ্যলগ্নে শাহি স্নান ঘিরে কী পরিমাণ উন্মাদনা সৃষ্টি হতে পারে, তা আন্দাজ করা কঠিন ছিল না উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের কাছে। কিন্তু তাদের বহুলপ্রচারিত ‘ডিজিটাল মেলা’ও যে আদৌ প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি, পূর্বের মতোই দিঙ্নির্দেশিকা ঘিরে বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা, অপর্যাপ্ত পুলিশি ব্যবস্থা, শেষ মুহূর্তের হুড়োহুড়ি অব্যাহত থেকেছে, ত্রিশ জন তাঁদের জীবন দিয়ে সে কথা প্রমাণ করে দিলেন।
আবার প্রমাণিত হল কুম্ভমেলা আজ রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রদর্শনের অন্যতম প্রাঙ্গণ। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রয়োজন আগাগোড়াই চাপা পড়ে যায় ‘ভিআইপি সংস্কৃতি’র প্রবল চাপে। এ বারও গোড়া থেকেই কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীদের উপস্থিতি মেলাপ্রাঙ্গণ আলো করে থেকেছে, পুলিশও অতি ব্যস্ত থেকেছে তাঁদের সামলাতে। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। ধর্ম ও রাজনীতিকে একাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে মহাগ্রহী বিজেপি সরকার যে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এই মেলাকে অমূল্য তাস হিসাবে ব্যবহার করতে চাইবে, তা নিশ্চিতই ছিল। মুখ্যমন্ত্রী যোগী মেলার নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রেখেছিলেন। দাবি ওঠা সত্ত্বেও বিপুল জনসমাগমের নিয়ন্ত্রণের ভার সেনার হাতে তুলে দেননি। দুর্ঘটনার পরেও অবিচলিত ভাবমূর্তিটি বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন যাতে তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় মহাকুম্ভ কালির ছিটে হয়ে থেকে না যায়। আর যাঁরা চলে গেলেন? “এত বড় সমাবেশে এমন ছোট ঘটনা”য় আপাতত ক্ষতিপূরণের অঙ্কেই তাঁদের পরিমাপ করা হবে।